ঘটনাপ্রবাহঃ ১ (পাকিস্তান)
২০১৬ সালের ৮ জুন। জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হলো জিনাত রফিক নামের এক আঠারো বছরের কিশোরীকে। হত্যাকারী তার-ই জন্মদাত্রী মা। যিনি স্বীকার করলেন, পরিবারের সম্মান রক্ষার্থে কাজটা করেছেন তিনি। কেননা সবার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে জিনাত নিজেই নিজের জীবনসঙ্গী বেছে নিয়েছিলেন। পরিবারের সম্মানহানি হয়েছে না তাতে?
এরপরের ঘটনাটা ২০১৮ সালের। এক চাষীর ফোন পেয়ে পুলিশ তার খামার থেকে উদ্ধার করে ২৬ বছর বয়সী মাদিহার জবাই কৃত লাশ। মাদিহা ছিলেন পাকিস্তানের পূর্ব পাঞ্জাব প্রদেশের নওশেরা ওয়ারকান সম্প্রদায়ের একজন তরুণী।
স্থানীয় পুলিশ অফিসার আলী আকবর জানালেন, “তার (মাদিহার) বাবা-মা তার বিয়ের বিরুদ্ধে ছিলেন। প্রাথমিক তদন্ত নির্দেশ করছে, তার মা ও দুই ভাই সম্মান রক্ষার দোহাইয়ে হত্যা করেছে তাকে।”
স্থানীয়দের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, চার বছর আগে মাদিহা তার প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিলেন। মৃত্যুর মাত্র কয়েকটা দিন আগে তার বড়বোনের মাধ্যমে তার সাথে যোগাযোগ করা হয়। পরিবার থেকে আশ্বস্ত করে বলা হয়, কোন ভয় নেই। বাড়ি ফিরলে সাদরে গ্রহণ করা হবে তাকে৷
পুলিশ স্টেশনে বসে মাদিহার মা ইকবাল বিবি জানালেন, “আমরা তার সাথে দেখা করলাম। বললাম ফিরে আসতে। তার ভুল (পালিয়ে বিয়ে করার) ক্ষমা করা হয়েছে৷ ফেরার পথে আমার দুই ছেলে মোটরবাইক থামিয়ে আমাকে অপেক্ষা করতে বললো। তারপর মাদিহাকে একটা খামারের দিকে নিয়ে গেলো তারা। সেখানে মেরে ফেললো।”
কেন? মাদিহার মা ও ভাইদের ভাষ্যমতে, পালিয়ে চলে গিয়ে পরিবারের অসম্মান করেছিলো মাদিহা। সেই সম্মান রক্ষার্থেই অসংখ্যবার ছুরিকাঘাত করা হলো তার সারা শরীরে। অনবরত ছুরি চালানো হলো গলায়।
ঘটনাপ্রবাহঃ ২ (ভারত)
২০০২ সালের ফেব্রুয়ারিতে নিতিশ কাটারাকে অপহরণ করলেন রাজনীতিবিদ ডিপি ইয়াদাভের পুত্র বিকাশ ইয়াদাভ ও তার চাচাতো ভাই বিশাল ইয়াদাভ। বিকাশ ইয়াদাভের বোন ভারতীর সাথে সম্পর্ক ছিলো নিতিশের। যা ভারতীর পরিবার কখনওই মেনে নেয়নি। হুমকি ধামকি দিয়েছিলো তাই নিতিশকে। তারপর ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০০২ সালে, এক বন্ধুর বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে অপহৃত হয়েছিলেন নিতিশ। তিনদিন পরে এক হাইওয়ের কাছে পাওয়া গিয়েছিলো তাকে। হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে মারার পর, আগুনে দগ্ধ হওয়া এক মৃতদেহ তখন তিনি।
মনোজ ও বাবলি দম্পতির ঘটনা তো বেশ বিখ্যাত এক ঘটনা। আলাদা উইকিপিডিয়া পেইজ আছে তাদের হত্যাকাণ্ড নিয়ে।
২০০৭ সালের জুন মাসে খাপ পঞ্চায়েতের (এক সুপ্রচলিত গ্রাম্য সালিস-দরবার বা বিচার সভা) নির্দেশে বাবলির স্বজনের হাতে নিহত হন এই দম্পতি। তাদের অপরাধ, একই গোত্রের মধ্যে বিয়ে করেছিলেন তারা। সালিস সভায় মৃত্যুর পূর্বে মনোজ ও বাবলি দু’জনকেই আদেশ করা হয়েছিলো তারা যেন একে অন্যকে ভাইবোন মেনে নেন। রাজি হননি তারা। ফলে তাদের ধরে জোর করে গেলানো হলো কীটনাশক। তারপর শ্বাসরোধ করে মেরে লাশ নিক্ষেপ করা হলো বারওয়ালা শাখার খালে।
ঘটনাপ্রবাহঃ ৩ (বাংলাদেশ)
২০২০ সালের ২৩ জুন রাতে, ১৬ বছর বয়সী লাইজু আক্তারকে হত্যা করলেন তার-ই জন্মদাতা পিতা সোনু মিঞা, মামা মাজু মিঞা ও ভাই আদম আলি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার মেয়ে এই লাইজু। মৃত্যুর আগের দিন অর্থাৎ ২২শে জুন, তাকে ধরমন্ডল গ্রামের এক নির্জন জায়গায় স্থানীয় এক তরুণের সাথে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখে ফেলেন তার মামা মাজু মিঞা। পরদিন রাতে তাই শাস্তিস্বরূপ, তিনি (মাজু) লাইজুর বাবা ও ভাইয়ের সাথে একত্রিত হয়ে তাকে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন।
উপরের ঘটনাগুলো তো পড়লেন। কিছুটা হলেও বুঝতে পারছেন, ‘অনার কিলিং’ আসলে কী? টের পাচ্ছেন এটা কতটা অসুস্থ এক প্রথা।
যাই ঘটুক, যত বড়োই হোক অপরাধ (ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড ছাড়া) তার শাস্তি এমন চূড়ান্ত তো হতে পারে না। পারে কি?
আমাদের দেশের গ্রাম্য সালিসগুলোতে প্রায়ই দেখা যায়, ধর্ষিতার শাস্তি হচ্ছে। ধর্ষণের শিকার হওয়ার পরেও আরও অনেক অনেক ভোগান্তি ভুগতে হচ্ছে তাকে। সালিসের বিচারে দিব্যি পার পেয়ে যাচ্ছে ধর্ষক। আর ভ্রান্ত শরীআহ আইনে ফেঁসে যাচ্ছে নির্যাতিত মেয়েটি। সমাজের সম্মান রক্ষার দোহাইয়ে তার কপালে জুটছে ১০১ বেত্রাঘাত। আর তার পরিবারকে দিতে হচ্ছে জরিমানা। গ্রামের হর্তাকর্তাদের নির্দেশে ছাড়তে হচ্ছে নিজেদের আবাসস্থল।
আজ থেকে এগারো বছরের বেশি আগে ফোর্বস ম্যাগাজিনে মেলিক কায়লান নামক একজন এমনই এক ঘটনা প্রসঙ্গে লিখেছিলেন-
“….চলুন যুক্তিতে আসি৷ কমবয়সী মেয়েটা হয়তো আতঙ্কের বশে ধর্ষণের ঘটনা চেপে গিয়েছিলো। আর তার নীরবতার সুযোগ নিয়েছিলো তার পরিবারের সদস্যগণ। হুট করে বিয়ে করা স্বামী নাহয় তাকে (মেয়েটাকে) সময়ের আগে গর্ভবতী দেখে নিজেকে প্রতারিত ভেবেছিল৷ ভেবেছিল মেয়েটা চরিত্রহীনা, ঠকিয়েছে তাকে। কিন্তু মেয়েটার ভোগান্তির কী হবে? জীবন নষ্ট হয়ে যাওয়া অসুস্থ শরীরের একটা মেয়ের শাস্তি কি হতে পারে ১০১ বেত্রাঘাত? এমন ভয়াবহ নির্মমতা তার প্রাপ্য? সহানুভূতি নেই তার জন্য? আর কেমন সামাজিক বা ধর্মীয় কানুন ধর্ষককে ক্ষমা করে?”
২০০৩ সালে নিউইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিনে, সাহসী ও বুদ্ধিমতী সাংবাদিক ক্যাথরিন জোয়েফের কলমে উঠে এসেছিলো গা শিউরে দেয়া একটা প্রতিবেদন। বিষয়ঃ সিরিয়ার অনার কিলিং। ঐ প্রবন্ধে ক্যাথরিন জাহরা নামের এক সিরিয়ান কিশোরীর ঘটনা তুলে ধরেছিলেন। জাহরাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে তার বাড়ি থেকে বের করে এনে ধর্ষণ করা হয়েছিল। তারপর নিরাপত্তার খাতিরে তার স্থান হয় সিরিয়ার জেলখানায়। তার বিপদের আশংকা কার কাছ থেকে ছিলো জানেন? তার নিজের পরিবারের কাছ থেকে! পরে এই নিরাপত্তার খাতিরেই কোন এক কাজিনকে বিয়ে করার শর্তে মুক্তি হয় তার। কিন্তু ঘটনা ততোদূর পর্যন্ত এগুতে পারেনি। কারাগার থেকে বেরুনো মাত্রই জাহরা খুন হন তার ভাইয়ের হাতে। পরিবারের সাথে হওয়া অসম্মানের শোধ ছিলো এটা।
কিছু কিছু মুসলিম দেশ যেমন মরোক্কো, ইয়েমেন, আফগানিস্তান, পাকিস্তান- এদের অনার কিলিংয়ের বিপরীতে শাস্তি হয় না কোন। যদি প্রমাণ করতে পারেন, হত্যাকাণ্ডটা সম্মান রক্ষার্থেই ঘটেছিলো।
বাহ চমৎকার! তাই না? স্রেফ একটা যুক্তির মাধ্যমে ন্যায্যতা প্রমাণ হচ্ছে নির্মম প্রাণনাশের।
এখন স্বাভাবিকভাবেই একটা প্রশ্ন আসবে মনে, এই অনার কিলিংয়ের শুরু কোথায়? কোত্থেকে হলো এর উৎপত্তি? উত্তর জানতে হলে অনেক পেছনে যেতে হবে আমাদের।
অনার কিলিংয়ের শুরু
১৭৮০ বিসিই (Before Common Era) বা ১৭৮০ খ্রীষ্টপূর্ব অব্দের আশপাশের কোন সময়ের কথা। তৎকালীন ব্যাবিলন (বর্তমান ইরাক) শাসিত হত ‘দ্য কোড অফ হামুরাবি’ নামক আইনমালায়। যার প্রণেতা ছিলেন রাজা হামুরাবি। এই আইনানুযায়ী, কোন নারীর যৌন অধিকারের নির্ধারক ছিলের তার স্বামী। যদি কোন একভাবে সেই নারীকে অন্য এক পুরুষের সম্পর্ক বা অন্য কোনভাবে সম্পৃক্ত পাওয়া যেতো, তবে তাকে সেই পুরুষ বা প্রেমিকের সাথে বেঁধে দিয়ে পানিতে ডুবিয়ে দেয়া হতো। অবশ্য স্বামী চাইলে তার স্ত্রীকে বাঁচাতে পারবেন। তবে সাথে বেঁচে যাবে ঐ অন্য পুরুষটাও!
১৭ বিসিই বা খ্রীষ্টপূর্ব ১৭ অব্দ। রোমের প্রথম সম্রাট অগাস্টাস নতুন নিয়মনীতি চালু করলেন। ‘লেজেস জুলিআ’ (Leges Juliae= Julian Laws) বা ‘জুলিয়ানের আইন’ ছিলো সেই নীতিমালার নাম। এর অন্তর্ভুক্ত একটা নীতি ছিলো Lex Julia de Adulteriis বা ব্যভিচার হচ্ছে একটি প্রকাশ্য ও ব্যক্তিগত অপরাধ। আর এই নীতির ফলে, পরিবারের প্রধান পুরুষ কর্তা ব্যভিচার বা প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলার অপরাধে আইনগতভাবেই তার বাড়ির নারীদের হত্যা করতে পারতো। এখন হোক সে মহিলা তার স্ত্রী, বা কন্যা।
৫১০ খ্রিস্টাব্দের দিকে প্রচলিত ছিলো সতীদাহ প্রথা। এরান শহরে (বর্তমান ভারতের কেন্দ্রে অবস্থিত মধ্য প্রদেশ) বিধবাদের উৎসাহিত ও বাধ্য করা হতো মৃত স্বামীর সাথে চিতায় আত্মাহুতি দিতে। এতে পাপমোচন হবে বিধবার, আর তার স্বামী পাবে মুক্তি।
৭ম শতকের পূর্বে, আরব উপদ্বীপগুলোতে মুসলিম সভ্যতা গড়ে উঠার আগে, একটা প্রবাদ খুব মানতো তারা। ‘কন্যা সন্তানদের সমাহিত করা একটা বনিয়াদি কাজ’। আর এই প্রচলিত প্রবাদের ফেরে যাযাবর উপজাতিরা কী করতো জানেন? সদ্যোজাত কন্যা সন্তানকে জীবন্ত পুঁতে ফেলতো। যাতে তারা বড় হয়ে নিজ গোত্রের জন্য কোন অসম্মান বয়ে না আনতে পারে।
১৭০০ খ্রিস্টাব্দে ‘কারো কারি’ (পাকিস্তানি ভাষায় অনার কিলিং) নামক এক খুনে প্রথায়, যারাই সম্প্রদায়ের জন্য অসম্মান বয়ে আনতো যৌন সীমালঙ্ঘনের অজুহাতে খুন করা হতো তাদের। এই প্রথার বুৎপত্তি তালপুর শাসনামলের সিন্ধ প্রদেশ থেকে। যা পরে ছড়িয়ে পড়ে পুরো দেশে।
(কারো কারি/ Karo kari অর্থ কলঙ্কিত পুরুষ, কলঙ্কিত নারী)
বিংশ শতাব্দীতে সাদ্দাম হুসেইনের প্রবর্তিত ইরাকি পেনাল কোডের আর্টিকেল নং ১১১ অনুযায়ী, কোন পুরুষ তার পরিবারের সম্মান রক্ষার্থে তার কোন আত্মীয়াকে হত্যা করলে শাস্তি ও প্রসিকিউশন হবে না তার। এদিকে ভারতে বেড়ে যায় কন্যা ভ্রূণহত্যার সংখ্যা। বিশেষ করে হারিয়ানা ও পাঞ্জাব প্রদেশে।
এটুকুতে এসে বুঝতেই পারছেন এই নির্মম প্রথা বিভিন্ন রূপ ও নামে চলে আসছে সেই প্রাচীন কাল থেকেই। ফলে প্রাণ হারিয়েছে, হারাচ্ছে অসংখ্য মানুষ। বিশেষ করে নারীরা।
কিন্তু এর পেছনের কারণ বা এই হিংস্রতার পক্ষে সমর্থন ও যুক্তি কী?
অনার কিলিং- কারণ, প্রভাব ও ভিক্টিম ব্লেমিং
কানাডার ডিপার্টমেন্ট অফ জাস্টিস থেকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বারজিয়েট ইউনিভার্সিটির (প্যালেস্টাইনে অবস্থিত) ডক্টর শরীফ কানাআনার মতে, আরব সংস্কৃতিতে অনার কিলিং এর উদ্দেশ্য শুধুমাত্র বা একমাত্র নারীর যৌন অধিকারকে নিয়ন্ত্রণ করা নয়। তিনি বলেন,
‘পরিবার, গোত্র বা সম্প্রদায়ের পুরুষেরা তাদের পিতৃগোত্রজ সমাজে বংশোৎপাদনকারী ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ খোঁজে৷ গোত্রের নারীদের তারা ভাবে পুরুষ তৈরির একটা কারখানা। অনার কিলিং তাদের জন্য যৌন ক্ষমতা বা আচরণ নিয়ন্ত্রণের একটা মাধ্যম নয়। এর পেছনে আছে গর্ভের উর্বরতার ব্যাপার বা বংশোৎপাদনকারী ক্ষমতা।’
ইউনিভার্সিটি অফ লুইসভিলের সাবেক প্রফেসর এবং কোরআন শরীফে অভিজ্ঞ রিফাত হাসান বলেন, “মুসলিম সংস্কৃতি অনেক কিংবা বলা যায় বেশিরভাগ মহিলাকে সুতো দিয়ে বাঁধা পুতুলের অবস্থানে নামিয়ে দিয়েছে। পরিণত করেছে দাসীর মতো প্রাণীতে যাদের একমাত্র কাজ পুরুষের মনোরঞ্জন করা ও চাহিদা মেটানো।”
আর এর বাইরে যাওয়া মানেই সীমালঙ্ঘন। পরিবারের অসম্মান। তারপর সেই অসম্মানের শিক্ষা বা শোধ হয়ে আসে ঘৃণ্য এই জঘন্য হত্যা প্রথা।
মজার ব্যাপার হলো, সাধারণত এই সম্মান হত্যা বা অনার কিলিংয়ের কাজটা সম্পাদন করে থাকে ভিক্টিমের বাবা, ভাই অথবা মামা-চাচারা। স্বামীরা নয়।
যদিও পিতৃপ্রধান এই সমাজ ব্যবস্থায় স্ত্রীদের দেখা হয় স্বামীর সম্পত্তি হিসেবে, তবু তাদের কোন অসদাচরণের জন্য অসম্মান বইতে হয় বাবার পরিবারকে। বেঁচে যায় স্বামীর পরিবার। তাই-ই বোধহয় নিয়ম ভাঙার অপরাধে অপরাধী নারীকে খুন হতে হয় রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়ের হাতে।
সমাজে আরেকটা মিথ বা ব্যাপার খুব প্রসিদ্ধ। আমাদের নিজেদের দেশেই। ভিক্টিম ব্লেমিং । ‘ভালো মেয়েরা এটা পরে না’ , ‘ওটা করে না’ , ‘অত জোরে হাসে না’ , ‘রাত-বিরেতে কোন ছেলের সাথে কথা বলে না’ , ‘সন্ধ্যার পর ঘর ছেড়ে বেরোয় না।’, ‘পড়াশোনা বেশি করলে বেয়াড়া হয়ে যায়।’, ‘ক্ষমতা দিতে নেই এদের হাতে।’, ‘স্বাধীনতা একদম নয়।’ আর এর বাইরে গেলে সে খারাপ। সমাজ বহির্ভূত। তার সাথে কোন অন্যায় ঘটলেও তার-ই দোষ সেটা। নিশ্চয়ই সে সম্মান নষ্ট করেছে। ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে বংশের মর্যাদা। আপনার কী মনে হয়, এটাও অনার কিলিংয়ের একটা অংশ বা ধাপ নয়? মেয়েটাকে সবাই মিলে মারছেন না মানসিকভাবে? যার সাথে ইতোমধ্যেই অন্যায় হয়ে গেছে, জীবন নষ্ট হয়ে গেছে যার- তাকে এভাবে দোষারোপ করা কি পাশবিকতা নয়? সহানুভূতি শব্দটা কি খুব দুর্বোধ্য আমাদের কাছে?
অনার কিলিংয়ের প্রভাব এখন পুরো বিশ্বব্যাপী। প্রতি বছর অসংখ্য নারী শিকার হচ্ছে এর। জাতিসংঘের অনুমানে সেই হিসেব ২০০০ থেকে ৫০০০। বিভিন্ন মানবিক সংস্থার উপর ভিত্তি করে প্রকাশিত বিবিসির এক রিপোর্ট অনুযায়ী সংখ্যাটা ২০,০০০।
ক্রমবর্ধমান আরব, পাকিস্তানি, ও আফগান সম্প্রদায়ের বিভিন্ন পশ্চিমা দেশে গড়ে ওঠা বা বসতি স্থাপনের ফলে ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া’সহ অন্য আরও দেশগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ছে এই হিংস্র প্রথা।
আমার মনে পড়ে, ২০০৯ সালের একটা ঘটনার কথা। ইরাকি-আমেরিকান তরুণী নূর আলমালেকির হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহতা পুরো নাড়িয়ে দিয়েছিলো পশ্চিমাদের। সিবিএস এর সংবাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, নূর আলমালেকি চার বছর বয়স থেকেই এরিজোনার বাসিন্দা। বড় হয়েছেন ওখানকার পরিবেশে। ফলে স্বভাবতই তিনি ছিলেন স্বাধীন চিন্তাভাবনার একজন। ব্লু জিন্স পরতে স্বচ্ছন্দ বোধ করা এই তরুণী বিশ বছর বয়সে বাবা-মায়ের বাড়ি ছাড়েন। এরপর থাকতে শুরু করেন তার প্রেমিক ও প্রেমিকের মায়ের সঙ্গে। পরিবারের পছন্দের ছেলেকে বিয়ে না করে, প্রেমিকের সাথে গিয়ে বাস করার ব্যাপারটা তার বাবা মেনে নিতে পারেননি। ফলে মেয়েকে একটা মিনিভ্যান দিয়ে চাপা দিয়ে মেরেই ফেলেছিলেন তিনি।
আচ্ছা, হ্যারি পটারের পদ্মা পাতিলকে মনে আছে আপনাদের? স্ক্রীনের ভারতীয় যমজ দু’বোন। সবসময় হাত ধরে একত্রে হাঁটে। তাদের একজন পদ্মা পাতিল। এই চরিত্রের পেছনে থাকা আফসান আজাদ নামের ঐ অভিনেত্রী ২০১০-এ জখম অবস্থায় অভিযোগ করেন, এক হিন্দু তরুণকে ভালবাসার অপরাধে তার বাবা ও ভাই তাকে তাদের ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারের বাড়িতে হত্যা করার চেষ্টা করেন।
এসব ঘটনায় পশ্চিমা দেশগুলোতে অনার কিলিং প্রথাটা বেশ পরিচিত হয়ে গিয়েছিল। সাথে পশ্চিমাদের এটাও বোঝা হয়ে গিয়েছিল— মেয়েরা যখন নতুন কোন স্থান বা পারিপার্শ্বিকতার মুখোমুখি হয় বা হচ্ছে, নতুন চিন্তাধারা তৈরি হচ্ছে তাদের। আচরণ, ফ্যাশন, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি সবকিছুতে প্রভাব পড়ছে ওখানকার। ফলে তাদের বাবা, চাচা-মামাসহ অন্যসব পুরুষ আত্মীয়রা ভাবছে, ঐ মেয়েগুলোর যৌন আচরণ বা বংশোৎপাদনকারী ক্ষমতার উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে তারা। ফলে অসম্মানিত হচ্ছে পরিবার, গোত্র বা সম্প্রদায়।
আইন ব্যবস্থা, প্রতিরোধ
এই ঘৃণ্য প্রথা বা রীতিটা যেভাবে বাড়ছে সেভাবে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। যেমন- এ বছরের ১১ জুন ভারতের মাপুসা কোর্ট এক কন্যা হত্যাকারী পিতাকে জামিনে মুক্তি দেয়। কেন?
আসামিপক্ষের আইনজীবীর দাবী, যদিও মেয়েটা তার বাবার হাতে ক্রিকেট স্টাম্পের মার খেয়েই মারা গেছে, তার বাবার উদ্দেশ্য আসলে তা ছিল না। এটা ছিল স্রেফ রাগের বশে করা একটা ভুল। স্রেফ সাধারণ একটু শাসন বা শাসনের ফেরে গায়ে হাত তোলা। ব্যস!
আইনে সংশোধন আসছে হয়ত। অনার কিলিংয়ের শাস্তি হিসেবে আওড়ানো হচ্ছে হত্যার বিপরীতে থাকা আইনগত শাস্তিগুলোকে।
২০০৭ সালে ঘটা মনোজ ও বাবলির সেই নির্মম হত্যাকাণ্ডের জন্য ২০১০ এ পাঁচজনকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছিলো। শাস্তি নির্ধারণ করা সেই পঞ্চায়েত প্রধানের হয়েছিলো কারাদণ্ড।
আফসান আজাদের বাবা-ভাইর শাস্তি হয়েছিল। মাদিহার মা ও ভাইদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ। ২৫ বছরের কারাদণ্ড পেয়েছিল বিকাশ ও বিশাল ইয়াদাভ।
কিন্তু বিচারের এই সামান্য কয়েকটা নজিরের বিপরীতে আছে হাজারো নির্যাতিতা আর মৃতার হাহাকার, তাদের সাথে ঘটে যাওয়া অতুলনীয় অন্যায়।
আইনের সঠিক প্রয়োগের অভাবে এখনও ঘটছে এই ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ড। আঙুলের ফাঁক গলে বেরিয়ে যাচ্ছে অপরাধীরা। ভ্রান্ত যুক্তি ও শাসনের সালিস পঞ্চায়েত গুলো টিকে আছে এখনও।
আর আমার আপনার চোখের সামনে নিত্যনতুন তৈরি হচ্ছে জাহরা, নূর আলমালেকি, নিতিশ, মনোজ-বাবলিরা।
feature image source: The Conflicted
References:
- Family members confess to honour killing in Brahmanbaria
- No More Honor Killings
- The evolution of honour killing
- Karo kari (honor killing) in Pakistan: A hermeneutic study of various discourses.
- Harry Potter Actress’s Brother, Father Allegedly Attempt to Kill Her
- Honor Killings or Shame Killings in Asia
- Mapusa: After rejection, court grants bail to accused in honour killing case
- Honour Killings: Are we prepared to tackle the problem?
- A daughter killed by her family – a story of love and ‘honor’
- Nitish Katara, Manoj-Babli: 5 honour killing cases that shocked India
- Father of ‘Honor Killing’ Victim Noor Almaleki to Stand Trial in November
- Honor Thy Father: A Muslim man in Phoenix “honor killed” his Americanized daughter