মালেশিয়ার জোহর প্রদেশের স্কুডাই এলাকা থেকে জার্মানির কোলন শহরের দূরত্ব কত? এমন অদ্ভুত প্রশ্ন শুনে অনেকেই এখন গুগলের রাজ্যে ঢুঁ মারতে পারেন ! গুগল সার্চে “১০,৩৩৭ কি.মি” দেখার পর আপন মনে বলতেই পারেন “ অহ , আচ্ছা ! কিন্তু …. ”। পাঠকের মনে ক্ষণিকের জন্য ‘কিন্তু’টা থাকুক, এই ‘কিন্তু’র উত্তর না হয় পাঠকই আবিষ্কার করুক আর্টিকেলে চিত্রিত রাজ্যে। জার্মানি এবং মালেশিয়া ! কত শত সহস্র কিলোমিটার দূরের দুইটি দেশ, সময়ের হিসেবে পার্থক্যও নেহায়েত কম নয়; প্রায় ৭ঘণ্টা! এত এত হাজার কিলোমিটার দূরত্বে মুহূর্তের মধ্যে যোগাযোগ করার বিষয়টি কয়েক শ’ বছর আগেও যেখানে ছিল নিতান্ত আকাশ কুসুম কল্পনা, সেই অসম্ভব বিষয়টিই আজ চলে এসেছে বিশ্ববাসীর হাতের মুঠোয়। আর এই অসম্ভবকে সম্ভব করার চোখ ধাঁধানো রাজ্যে যেসব বিষয় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে কম্পিউটার সাইন্স যে তার অন্যতম, সে কি আর বলার অপেক্ষা রাখে? কম্পিউটার সাইন্স ! বিষয়টির নামের মধ্যেই কেমন যেন একটা আগ্রহ , কেমন যেন একটা প্যাশন, কেমন যেন একটা অদ্ভুত টান কাজ করে অনেকের। আজ এমনই একজন মানুষের সাথে গল্পে গল্পে পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দিবো যিনি জেনেটিক্সের মত প্রচুর সম্ভাবনাময় বিষয়ও ছেড়ে দিয়েছেন কম্পিউটার সাইন্সে পড়ার প্যাশনে, পাড়ি জমিয়েছেন ভিন দেশে, আবিষ্কার করেছেন একের পর এক কম্পিউটার কারিশমা, হয়েছেন অনেকের জন্য অনুপ্রেরণা।
বলছিলাম মোহাম্মদ আল ফাত্তাহ’র কথা। কত শত ব্যস্ততার মাঝেও তিনি বিনয়ের সঙ্গে সময় দিয়েছেন; আন্তরিক কৃতজ্ঞতা তাঁর প্রতি। প্রায় ৭ঘণ্টার সময়ের ব্যবধান কিংবা ১০,৩৩৭ কিলোমিটারের দূরত্বে মুহূর্তের মাঝে যোগাযোগের প্রযুক্তি যারা এনে দিয়েছেন তাঁদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা; পাঠককে আর অপেক্ষা না করিয়ে বরং বেরিয়ে পড়া যাক এক অন্যরকম রোমাঞ্চকর অধ্যায়ের সন্ধানে। সঙ্গী হিসেবে পাশে পাচ্ছি মোহাম্মদ আল ফাত্তাহকে।
মাওলানা ভাষানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেটি জেনেটিক্স নিয়ে পড়ছে। আশেপাশের সহপাঠীরা তুমুল আগ্রহে ডুব দিচ্ছে জেনেটিক্সের সম্ভাবনাময় জগতে। জেনেটিক্সের বদৌলতে চোখের পলকে কত কিছু বদলে যাচ্ছে সারাবিশ্বে। প্রায় বছরখানেকের মত পড়ালেখা করার পরও কোথায় যেন ছেলেটির অদ্ভুত এক শুন্যতা কাজ করছে ! ছোটবেলা থেকেই কম্পিউটারের প্রতি প্রবল ঝোঁক। পড়ার ইচ্ছেও ছিল কম্পিউটার নিয়েই। শৈশবে গেমস খেলার ভিড়ে ছেলেটির মনে প্রায়শই প্রশ্ন জাগতো, “ আচ্ছা, এই কম্পিউটার গেমস আসলে কীভাবে কাজ করে ?” প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই হোক কিংবা নিজের মনের খোরাক যোগাতেই হোক ছেলেটি দেশের বাইরে পড়তে যাবার সিদ্ধান্ত নিল এবং অবশ্যই তা নিজের পছন্দের বিষয় কম্পিউটার সাইন্সে। অফারও পেয়ে গেলেন বিশ্ব র্যাংকিং-এ দাপটের সাথে রাজত্ব করা এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় ‘ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি মালেশিয়া’তে (ইউ টি এম)। উল্লেখ্য, শুরুতে ক্যানাডার নোভা স্কশিয়ার ডাল হউসি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ হলেও পরবর্তীতে নানা জটিলতায় আর যাওয়া হয়ে উঠেনি । স্বপ্নের পথে ছুটে চললো ছেলেটি, স্বপ্নের পথে ছুটে চললেন বাংলাদেশের ফাত্তাহ, মোহাম্মদ আল ফাত্তাহ । বিদেশ বিভূঁইয়ে ভিন্ন সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেয়া, নানা প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে এগিয়ে যাওয়া আর নিজের স্বপ্নের পথে অবিচল থাকা – এই তিনে মিলে চলছিল তাঁর জীবন।
শুরুতে C ল্যাঙ্গুইজ দিয়ে প্রোগ্রামিং শুরু করলেও ভার্সিটির কারিকুলামের সঙ্গে সঙ্গে C++ এ মনোনিবেশ করেন তিনি। তাঁর প্রোগ্রামিং শেখার মূল অনুপ্রেরণা ইউটিএমের জুমাইল স্যার। ধারাবাহিকভাবে তিনি PHP, JAVA, JAVA Scriptও শেখার তালিকায় যোগ করলেন। তবে তাঁর সবচেয়ে পছন্দের প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুইজ হল পাইথন। নতুনদের জন্য পাইথন দিয়ে প্রোগ্রামিং শেখাটাকে তিনি অধিক উপযোগী মনে করেন।
ভার্সিটিতে পার্কিং সমস্যার সমাধানে মালেশিয়ান বন্ধুদের সাথে তিনি একবার প্রজেক্ট হিসেবে তৈরি করে ফেললেন ‘পার্কিং নিঞ্জা’ নামের একটি অ্যাপ, যেখানে ভয়েস নেভিগেশনের অংশটুকুতে হিউম্যানলি ভয়েস দেবার চেষ্টায় নিজেরা নিজেদের ভয়েসই ব্যবহার করেছিলেন যা নিয়ে প্রজেক্ট প্রেজেন্টশনের সময় ক্লাসে সহপাঠীদের হাসির রোল পড়ে যায়। তবে প্রফেসর খুব প্রশংসা করেছিলেন। হাসতে হাসতেই মজার এই অভিজ্ঞতাটি শেয়ার করলেন তিনি পাঠকদের উদ্দেশ্যে।
লেখাপড়ার এত এত চাপের মধ্যেও সুযোগ পেলেই তিনি UTM-X, Imagine Engineering, HCI, Database প্রভৃতি সম্পৃক্ত প্রোগ্রামিং কন্টেস্টে অংশগ্রহণ করেছেন। স্বীকৃতিস্বরূপ পুরষ্কারও পেয়েছেন কমবেশি, বিশেষ করে HCI এবং Database – এ।
এত এত পড়াশোনার ভিড়ে তাঁকে আবার আঁতেল ভেবে ভুল করবেন না যেন। খেলাধুলায় নিয়মিত ফাত্তাহ হরহামেশাই অংশগ্রহণ করেন বিভিন্ন প্রতিযোগিতায়। প্রায় ১৭টি দেশের খেলোয়ারদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনটি বিভাগেই প্রথম হওয়া তো আর চাট্টিখানি কথা নয় ! International Students Sports Carnival 2017 সহ নানা প্রতিযোগিতায় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন কৃতিত্বের সঙ্গে।
একটুখানি বিরতি দিয়ে পাঠকদের এবার একটু নড়েচড়ে বসার সুযোগ দিতেই পারি ! এতক্ষণ ধরে হাসিমুখে পাঠকদের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা শেয়ার করা মানুষটাই বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষে থাকাকালীন ইন্টার্নশিপের সুযোগ পেয়ে যান প্রফেসর ইকো’র তত্ত্বাবধানে; কর্মজীবনে হাতখড়ির স্বাদ পান বায়োমেডিক্যাল সম্পর্কিত ওয়েব সাইট ডিজাইন এবং মেডিক্যাল ইকুইপমেন্টের হিসাব রাখার কিউ-আর কোড ভিত্তিক প্রোগ্রাম তৈরির মাধ্যমে। প্রোগ্রামিং কন্টেস্টে তাক লাগিয়ে অফার পান মালেশিয়ান চাইনিজ কোম্পানি কর্তৃক ‘গার্ডিয়ান’ এন্ড্রয়েড অ্যাপ্লিক্যাশনে কাজ করার। যদিও পড়ালেখার চাপে তিন মাসের মাথায় ছেড়ে দেন সে কাজ।
ইউ টি এম-এ কম্পিউটার প্রকৌশলে ২০২০ সালে ব্যাচেলর ডিগ্রী সম্পন্ন করা ফাত্তাহ মাঝে একটি সেমিস্টার ERUSMUS -এর স্কলারশিপ নিয়ে পড়েন ফিনল্যান্ডের Metropolia University of Applied Sciences-এ। [ আগ্রহী পাঠকরা চাইলে এ সম্পর্কে পড়তে পারেন এই লিংকে http://engineering.utm.my/computing/cs/journey-to-helsinki-finland/ ]
এখানেই শেষ নয়। পরবর্তীতে DAAD এর স্কলারশিপ নিয়ে পড়ার সুযোগ পান যান RWTH Aachen University তে। এখান থেকে তাঁকে পরবর্তীতে নিয়োগ দেয়া হয় IVU Traffic Technologies কোম্পানিতে। সেখানে তিনি জার্মানির বাস এবং ট্রেনের টিকেট সিস্টেমের স্ক্যানারের কিছু নতুন ফিচার মূল সফটওয়্যারে যোগ করেন। বর্তমানে জার্মানিতে তিনি TH Köln-এ কম্পিউটার প্রকৌশল নিয়ে মাস্টার্স করছেন।
গল্পে গল্পে ভুলেই গিয়েছিলাম বলতে ! ব্যাচেলর ডিগ্রি শেষ করতে না করতেই জার্মানির কোলন শহরে অবস্থিত ArangoDB নামে একটি ডাটাবেজ কোম্পানি থেকে চাকরির অফার পেয়ে যান বাংলাদেশের ফাত্তাহ, আমাদের মোহাম্মদ আল ফাত্তাহ। বর্তমানে এখানেই তিনি প্রায় ২ বছর যাবৎ আছেন সফটওয়্যার কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। বর্তমান প্রজেক্ট সম্পর্কে তাঁকে বলার অনুরোধ করলে এক রাশ হাসি নিয়েই বললেন, “আমাদের একটি চলমান প্রজেক্ট রিলিজ টেস্ট অটোমেশন প্রায় এক বছরের বেশি সময় ধরে চলছে। ArangoDB থেকে প্রতি ১৫ দিন পর পর নতুন ভার্সন রিলিজ হয় এবং সেগুলো রিলিজ হওয়ার পর আমাদের একদম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত টেস্টিং করতে হয়। সেই টেস্টিং প্রসেসিংটা আমরা ম্যানুয়াল থেকে ফুল অটোমেটেড করে ফেলার কাজটি করছি। এর মধ্যে আছে ইন্ট্রিগেশন টেস্টিং ইউনিট, টেস্টিং ইউ-আই,টেস্টিং অটোমেশন এবং ফাইনালি বাগ রিপোর্ট ও ট্র্যাকিং।” বিস্তারিত জানতে আগ্রহী কেউ চাইলে নিচের গিটহাব লিংক থেকে ঘুরে আসতে পারেন।
https://github.com/arangodb/release-test-automation
ইউরোপ! অনেকের কাছেই স্বপ্নের কর্মস্থল। ইউরোপের চাকরির বাজার নিয়ে প্রশ্নোত্তর পর্বে ঘুরেফিরে কর্মদক্ষতার প্রতিই বিশেষ জোর দিলেন তিনি।
প্রকৌশলী পিতা এবং গৃহিণী মাতার তিন পুত্রের মধ্যে ফাত্তাহ সবার ছোট। জন্ম, বর্ণাঢ্য শৈশব কিংবা দুরন্ত কৈশোর সবকিছুই তাঁর ঢাকা ক্যান্টনমেন্টকে ঘিরে। সেন্ট ভিন সেন্ট ডি পলস মিশনারি স্কুলে তাঁর শিক্ষাজীবনের হাতেখড়ি। ২০১১ সালে শহীদ পুলিশ স্মৃতি স্কুল থেকে এস এস সি এবং ২০১৩ সালে বি এ এফ শাহীন কলেজ থেকে এইচ এস সি পাশ করেন কৃতিত্বের সঙ্গে। তারপরের কাহিনী তো গল্পে গল্পে পাঠকের মনে বোধ হয় ইতোমধ্যেই গাঁথা হয়ে গেছে।
স্কুল জীবনে ক্রিকেট খেলতে গিয়ে প্রিন্সিপালের রুমের কাঁচ ভেঙ্গেছিলো তাঁর তৎকালীন বিচ্ছুবাহিনী যা কি না তদন্তের দায়িত্ব দেয়া দেয়া হয়েছিল তাঁদের সেই দলের উপরই। হাসতে হাসতেই ফাত্তাহ বললেন , “ বাংলায় একটা কথা আছে না ! অনেকটা যেন শিয়ালের কাছে মুরগি চুরির তদন্তের দায়িত্ব দেয়া , হা হা হা ! ”
ভ্রমণপিপাসু ফাত্তাহ’র কাছে ঘুরাঘুরি যেন অনেকটা ওষুধের মত। মনের অসুখের ওষুধ হিসেবে ভ্রমণের যেন জুড়ি পাওয়া ভার। ইতোমধ্যেই বিশ্বের প্রায় ১৫ টি দেশ ঘুরেছেন যার মধ্যে ইউরোপের ১২টি এবং এশিয়ার ৩টি দেশ রয়েছে। মালেশিয়ার পেনাংয়ে Homestay Program-এ থাকাকালীন স্থানীয় গ্রামবাসীদের সাথে বেশ সখ্যতা হয়ে যায় তাঁদের। প্রোগ্রামটি এমন যে, স্থানীয়রা ৩দিনের জন্য সন্তান নিচ্ছে পালক হিসেবে এবং তাঁদের ঐ সময়ের সকল প্রকার দায়িত্ব তাঁদের। এখনো তাঁদের সাথে প্রায়ই উৎসবে যোগাযোগ হয় ফাত্তাহ’র; হয় পারস্পরিক কুশল বিনিময়। সে সময়কার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে ফাত্তাহ বলেন, “ আমার এক বন্ধু তখন বলেছিল, এখানে জন্মগ্রহণ করলেও জীবনটা মন্দ হতো না। পাহাড়, প্রকৃতি আর গ্রামীণ পরিবেশে জীবনটা দিব্যি চলে যেত।” প্রতিনিয়তই ফাত্তাহ’র ভ্রমণের তালিকায় যোগ হচ্ছে নতুন নতুন দেশ এবং স্থানের নাম। কে জানে হয়তো একদিন বিশ্বভ্রমণেও বেরিয়ে পড়বেন !
শেষ করছি অনুপ্রেরণার দুনিয়ায় একটুখানি উঁকি দিয়ে। মোহাম্মদ আল ফাত্তাহ নামের বিনয়ী এই মানুষটি অকপটে স্বীকার করেছেন জীবনভর তাঁকে অনুপ্রেরণা দিয়ে যাওয়া মানুষদের অবদানকে। বিশেষ করে, তাঁর পরিবার এবং পিতা মাতার কথা না বললেই নয়। এ ছাড়াও কিছু উক্তি তাঁকে অন্যভাবে ভাবতে শিখিয়েছে।
“The computer was born to solve problems that did not exist before.”— Bill Gates
“If you think your users are idiots, only idiots will use it.” — Linus Torvalds
“পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি (তোমাকে) সৃষ্টি করেছেন।“ – [ সূরা আলাক্ব , আয়াত ১ ]
ভবিষ্যতে সফটওয়্যার টেস্টিং ফার্ম নিয়ে কাজ করতে চান মোহাম্মদ আল ফাত্তাহ, কাজ করতে চান মানবকল্যাণের নানা ধাপে। বিনীত হাসিতেই দোয়া চেয়েছেন আপনাদের সকলের কাছে।
শেষ হয়েও হল না শেষ। সব লেখারই কি শেষ হওয়া চাই ? কিছু প্রসঙ্গ থাকুক না অসমাপ্ত কিংবা অসামাধিত !
পাঠক জানেন কি, ১৬১ বছরেরও অধিক সময় ধরে অসমাধিত Riemann hypothesis এর সমাধান করার চেষ্টা করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। চাইলে এই যাত্রায় যোগ দিতে পারেন আপনিও। ও হ্যাঁ, এই অসাধ্য সাধনের পুরষ্কার কিংবা এর বিরল সম্মান সম্পর্কে জানতে ঢুঁ দিতে পারেন গুগলেও।