, ,

আহমদ ছফার ওঙ্কার: ভাষার অব্যক্ত আর্তনাদ

b5f04cb7-03f5-4a6c-812b-f51fa04c647b

হিন্দু-পুরাণ অনুযায়ী ওঙ্কার শব্দের অর্থ ‘আদি ধ্বনি বা সকল ধ্বনির মূল।’ নামান্তরেই একটা সুন্দর আবহ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন লেখক আহমদ ছফা। এরপর গোটা লেখায় ফুটিয়ে তুলেছেন সৌন্দর্য। শব্দের ঠাসবুনটে একটু একটু করে গল্পের স্তর সাজান। মানুষের দুই রকম দৃষ্টি থাকে। বাহ্য দৃষ্টি, অন্তর দৃষ্টি। বাইরের দৃষ্টিতে দুনিয়া দেখি, অন্তর দৃষ্টি দেখায় অদেখা সামগ্রিকতাকে। তেমনি যারা কথা বলতে পারেন না অর্থাৎ বোবা, তাদেরও কিন্তু ভাষা আছে। আমরা তা শুনতে পাই না, বুঝতে পারি না। বাইরের কান দিয়ে আমরা যা শুনতে পাই না, তা প্রতিধ্বনিত হয় অন্তরে। সকল চেতনায়, হৃদয়ের গহীনে সেই ধ্বনি বিরাজমান। ওঙ্কারে লেখক বুঝাতে চেয়েছেন সেটি। তাঁর বর্ণন কৌশল, ভাষার সাবলীল সংবেদনশীলতা পাঠককে উপলব্ধি করাবে এর তীক্ষ্ণতা। 

বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য দিকপাল আহমদ ছফা; © dailystar

গল্পের শুরু-শেষ এবং মাঝপথে বিস্ময়!

“আমাদের কিছু জমিজমা ছিল। বাবা নিজে করেননি। তিনি তাঁর বাবার কাছ থেকে পেয়েছিলেন। সম্পত্তির সঙ্গে একখানা মেজাজও তাঁকে পূর্ব-পুরুষরা দিয়ে গিয়েছিল। তাঁর তেজ বিশেষ ছিল না, তবে ঝাঁঝটা ছিল বেশ কড়া রকমের।”

পিতার বর্ণনা দিয়ে শুরু করেন লেখক। পিতার নাম নেই। নামহীন হলেও মোটেই অস্তিত্বহীন নন তাঁর পিতা। বরঞ্চ উপন্যাসের পরবর্তী অংশের রচয়িতা যতখানি লেখক, তার চেয়ে কোন অংশে পিতা মহোদয় কম নয়। আমাদের যারা বয়োজ্যেষ্ঠ, যারা এক দশকের মধ্যে পরলোকগমন করেছেন, তাদের দিকে দৃষ্টি সন্নিবেশিত করলে খেয়াল করবেন তারা সময়ের সঙ্গে সমাজ ব্যবস্থার যে পরিবর্তন সেটি মেনে নিতে পারেননি। তারা ছিলেন প্রাচীনকালের আভিজাত্য, অহংবোধ আর কুসংস্কারে বন্দি। তারা পরিবর্তন মানতে নারাজ। 

বংশের একধরণের গরিমা ছিল তাদের শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। কেউ কেউ ছোটবেলায় বিশাল জমিদারি দেখে বড় হয়েছেন। বড় হবার পর যুবক বয়সে যখন হাল ধরার প্রয়োজন আসে, জমিদারির সদ্ব্যবহার করে সম্পত্তি বাড়ানোর সময় আসে তখন তারা আমোদ ফূর্তিতে দিন কাটিয়ে সমস্ত জমিদারি হারিয়ে বসেন। হারালে হবে কী! রক্তে তারা জমিদার। মগজেও সেটি ঝালাই করা হয়ে গেছে। তাই কালচক্রের ঘূর্ণনে যারা তাদের অধীনস্থ ছিল, সেই তাদেরই পরিবার জ্ঞানে সম্পদে এগিয়ে গেলেও কথিত জমিদারের বংশধররা পুরনো গল্পের জাবর কেটেই একেকটি দিন পার করে। সেটি যে কত ভয়াবহ আগামীর দিকে ঠেলে দেয়, তারা তা বুঝতে পারে না। যতদিনে জ্ঞানচক্ষু খোলে, ততদিনে সব হারিয়ে নিঃস্ব হতে হয়।

ওঙ্কারে একটিমাত্র চরিত্রের নাম উন্মোচন করেন আহমদ ছফা। চরিত্রের নাম ‘আবু নসর মোক্তার।’ লেখক শেষে সম্মানসূচক ‘সাহেব’ বসিয়ে তাকে বানিয়েছেন আবু নসর মোক্তার সাহেব। আবু নসর আমাদের সমাজের সুবিধাবাজ সেইসব মানুষের অন্তর্গত যারা সুযোগ খোঁজে। কাঙ্খিত সুযোগ পেলে কার পিঠে ছুরি মারছে তা ভাবে না। মোক্তার সাহেব সুযোগসন্ধানী, চতুর এবং চূড়ান্ত লোভী। তিনি এক পুকুরের পানি আরেক পুকুরে ঢেলে ভারসাম্য আনয়নকারীদের দলে। রাজনৈতিক ক্ষমতাশালীদের সুনজরে আসতে যা যা করা প্রয়োজন, কোনোটাতেই কমতি রাখেন না তিনি। এই করতে করতে বাগে পেয়ে একদিন সর্বস্ব লুটে নেন গল্পের নায়কের পিতার। এবং এর পেছনে যথারীতি তার স্বার্থ লুকিয়ে থাকে। যার বলি হয় স্বয়ং নায়ক। 

বইয়ের মলাটে ‘ওঙ্কার’ ; © Jahirul Quayum Feroz 

নায়ক কীভাবে বলি হয়? কেনই বা হয়?

সেসব নিয়ে খানিক চর্চার প্রয়োজন আছে। স্পয়লারের ভয়ে যদি এখানে থেমে যান, তাহলে পাঠক আপনাকে নিশ্চিন্ত করছি। এই অংশটুকু জানলেও স্পয়লার হবে না। ওঙ্কারে স্পয়লারের কিছু নেই। সবটাই অস্পষ্ট। শুরুতে যেমনটা বলেছি, লেখক এখানে গল্প ফাঁদতে বসেননি। জীবন যেভাবে প্রতিদিন আপন গতিতে চলে, ওঙ্কারকে আহমদ ছফা সেভাবে টেনেছেন। কোনো সীমারেখা আঁকেননি। তাই নির্ভার থাকতে পারেন।

আবু নসর মোক্তার নায়কের পিতার খুব বিশ্বস্ত এবং কাছের মানুষ ছিলেন। নায়কের ভাষায়, বাবার ডান হাত-বাম হাত ছিলেন। জমিদারি রক্তের দাপটে কারণে-অকারণে এর ওর বিরুদ্ধে মামলা দিতেন নায়কের পিতা। সেগুলো মোক্তার সাহেব দেখভাল করতেন। কোন এক কারণে মোক্তারের বিরুদ্ধেই মামলা ঠোঁকেন পিতা মহোদয়। মোক্তারের কূটবুদ্ধির কাছে ধরাশায়ী হয়ে জমিজমা সব হারান। মোক্তার সেগুলো বাগিয়ে নেয়। এদিকে অসুস্থ হয়ে পড়ে পিতা। মোটামুটি মৃত্যুশয্যায়। চিকিৎসার পয়সা নেই। এমন অবস্থায় মোক্তার ত্রাণকর্তা হয়ে আসে। নায়কের মাকে প্রস্তাব দেয়, তার ছেলে অর্থাৎ নায়ক যদি মোক্তারের মেয়েকে বিয়ে করে তাহলে পিতা মহোদয়ের চিকিৎসার সম্পূর্ণ ভার তিনি নিবেন এবং সহায় সম্পত্তি ফিরিয়ে দেবেন। বিএ পাশ করে বসে থাকা নায়ক পিতা মাতা উভয়ের ইচ্ছার বিপক্ষে গিয়ে বিয়ে করেন মোক্তারের বোবা মেয়েকে।

লেখক আহমদ ছফার এক অনন্য কীর্তি এই বইটি; © Jahirul Quayum Feroz 

ওঙ্কার এবং স্বাধীনতা সংগ্রাম…

“গোটা বাংলাদেশের শিরা-উপশিরায় এক প্রসব বেদনা ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষের বুকফাটা চিৎকারে ধ্বনিত হচ্ছে নবজন্মের আকুতি।”

‘ওঙ্কার’ আহমদ ছফার দ্বিতীয় উপন্যাস। প্রথম উপন্যাস ‘সূর্য তুমি সাথী’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে। বাংলাদেশ তখন উত্তাল। ‘৬৬, ‘৬৯ পেরিয়ে ‘৭১! এর আগে গণ-অভ্যুত্থানের যে সামগ্রিক চিত্র, ওঙ্কার তারই সাহিত্য আকারে প্রকাশিত প্রতীকী রূপ। ষাটের দশকের শিক্ষা আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলনে গড়ে ওঠা স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিত্তি চূড়ান্তভাবে বিকশিত হয় ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। সাধারণ মানুষ রাজপথে নেমেছিল। রক্তের প্লাবন তাদের এতটুকু বিচলিত করতে পারেনি। নতুন ভোরের আশায় তারা অনবরত গর্জন করে গেছে। স্বপ্ন বাস্তবে রূপান্তর করা কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। সেই ব্রতে সমগ্র বাঁধা ঠেলে এগিয়ে যায় স্বপ্নবাজ বাঙালি। আসাদের রক্তে ভেজা শার্ট দিয়েছে প্রেরণা।

“বাংলাদেশের আকাশ কাঁপছে, বাতাস কাঁপছে। নদী, সমুদ্র, পর্বত কাঁপছে। চারপাশের সবকিছু প্রবল প্রাণাবেগে থরথর কাঁপছে।”

আহমদ ছফা ওঙ্কারে না বলা গল্পের ভীড়ে শোনাতে চেয়েছেন সেই গল্প। চেয়েছেন বাঙালির ত্যাগ, ডরহীন পথচলা তুলে ধরতে। স্বাধীনতা ছেলের হাতের মোয়া নয়, চাইলেই পেয়ে গেলাম! প্রয়োজন ত্যাগ, তপস্যা, একনিষ্ঠতা। তেমনি আপাত দৃষ্টিতে অবান্তর মনে হওয়া কোন ইচ্ছের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে হলে প্রয়োজন ভেতরকার শক্তি। গল্পে নায়কের বোবা স্ত্রীর প্রচেষ্টাও তেমনই! সুখ, স্বস্তি জলাঞ্জলি দিয়ে পরিবেশকে লেখক যেভাবে ধারণ করেছেন ওঙ্কারে, তার গভীরে পৌঁছানোর আগ অবধি পাঠকের মনস্তত্ত্বে বড়সড় ধাক্কা লাগবে। বলা বাহুল্য, যুদ্ধ বাঁধবে রীতিমতো!

ওঙ্কারের ইংরেজি নাম ও প্রচ্ছদ; © medium. com

ওঙ্কার কি উপন্যাস হিসেবে সফল?

উপন্যাস হতে হবে ইয়া মোটা বই, পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টালেও শেষ হবে না কাহিনি এমন ভাবনার বাইরে গিয়ে ওঙ্কার প্রমাণ করেছে উপন্যাস মানেই বিশালাকার নয়। মাত্র তিন ফর্মার (১ ফর্মা=১৬ পৃষ্ঠা) একটি বইও উপন্যাস হতে পারে, ছফা তা দেখিয়েছেন। বাংলা সাহিত্যে এত ছোট আকারের উপন্যাস দ্বিতীয়টি আর নেই। সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ধারাবাহিক আকারে প্রথম প্রকাশিত হয় ওঙ্কার। এরপর উপন্যাস আকারে আসলে স্বভাবতই হৈচে পড়ে চারিদিকে। তৎকালীন পত্র-পত্রিকায় আলোচনার ঝড় ওঠে। তবে ওঙ্কার পাঠের পর এর স্বকীয়তাকে এক বাক্যে স্বীকার করেছেন সবাই। এটি আকৃতিতে উপন্যাস না হলেও প্রকৃতিতে অবশ্যই উপন্যাসের কাতারবদ্ধ। অনেকটা স্মৃতিচারণের ভঙ্গিমায় সমাজ ও সময়ের বিবর্তন, রাজনৈতিক অবস্থা ও গণ জাগরণের আলেখ্য ফুটে ওঠে এতে। ওঙ্কারে কী নেই? পারিবারিক একটা গল্প আছে। আছে দাম্পত্য কলহ। অফিসের অশান্তি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, ভাঙা গড়া। প্রাত্যহিক টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যাওয়া নায়ক একসময় নিজেকেই নিজে ঘৃণা করতে শুরু করে। এর মাধ্যমে চিরায়ত সত্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে- ‘মানুষ সবকিছু থেকে পালিয়ে বাঁচলেও নিজের কাছ থেকে পালানো সম্ভব নয়।’ আত্নদহন তিলে তিলে শেষ করে দেয় একটা জলজ্যান্ত মানুষকে, তা উপলব্ধি করাবে নায়কের নিজের জন্য হওয়া করুণার অংশটুকু।

একটা উপন্যাস তখনই সার্থক যখন তা পাঠকের অন্তরের অভ্যন্তরে নিজেকে ঢুকিয়ে নিতে পারে। ওঙ্কার তাতে শুরু থেকেই সফল। ওঙ্কার পড়তে পড়তে পাঠকের মনে হবে মনের খাঁচায় বন্দি হয়ে আছে। খাঁচায় আবদ্ধ সিংহ যেমন সম্পূর্ণ অপরিচিত দৃষ্টিতে লোহার গরাদ পরখ করে, তেমন দৃষ্টিতে তাকাবে যুগ যুগান্তের পুরনো নিজস্বতার দিকে। পুরনো মডেলের গাড়ি শহরের নতুন রাস্তায় ঠিকঠাক চলতে না পারলেও উপন্যাসের চোরাগলিতে ওঙ্কার বুক ফুলিয়ে চলবে মুক্ত বিহঙ্গ হয়ে, সফলতার ডানায় চড়ে।

Related Articles

অন্যান্য
Sirajul Islam Mozumder

পিকি ব্লাইন্ডার্সঃ বিংশ শতাব্দীতে বার্মিংহামের রাস্তা দাপিয়ে বেড়ানো এক দস্যুদল

“বাই দি অর্ডার অব পিকি ব্লাইন্ডার্স”। আপনি যদি সিরিজপ্রেমী হয়ে থাকেন, তবে এই বাক্যটির সাথে

বিস্তারিত »
সোশ্যাল মিডিয়া
পাঠক প্রিয়
খেলা
ফেইসবুক পেজ