নাম তাঁর রেহানা। রেহানা মরিয়ম নূর। পেশায় একজন চিকিৎসক । এক স্থানীয় মেডিকেল কলেজে মেডিসিন বিভাগে আছেন সহকারী অধ্যাপক হিসেবে । চিকিৎসাশাস্ত্রের এই তরুণী ব্যক্তিগত জীবনে একজন বিধবা; এক কন্যা সন্তানের জননী।
নৈতিকতার প্রশ্নে শিক্ষিকা ডা. রেহানা সবসময়ই আপোষহীন। পরীক্ষার হল-এ স্কেলের পিঠে নকল লিখে আনার মত বিষয়কে কেন্দ্র করেও এক ছাত্রীকে বহিষ্কার করেছেন। কিন্তু এটা তো স্রেফ ছোট্ট একটা উদাহরণ মাত্র। স্রেফ একটা উদাহরণ ! তাহলে কি সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পাঠক এক রোমাঞ্চকর অধ্যায়ের আবিষ্কার করবে ? এই প্রশ্নের উত্তর বের করবার দায়িত্ব পাঠকদেরই উপরই ছেড়ে দেয়া যাক।
অনড় নীতির এই মানুষ ডা. রেহানা মরিয়ম নূর হঠাৎ এক জঘন্য ঘটনার মুখোমুখি হন। জানতে পারেন তাঁর ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা ডা. আরেফিনের যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে এই কলেজেরই এক ছাত্রী অ্যানি। লোকলজ্জার ভয়ে বিষয়টি চেপে রেখেছে সে; অভিযোগ করেনি কোথাও। কৌতূহলী পাঠকের মনে কি এবার রোমাঞ্চ ছড়াচ্ছে ? না জানি কী ঘটতে যাচ্ছে !
পাঠক নিশ্চয়ই এর মাঝে মস্তিষ্কের ক্যানভাসে এঁকে ফেলেছেন সম্ভাব্য ঘটনাপ্রবাহ; এঁকে ফেলেছেন এক প্রতিবাদী মানুষের প্রতিমূর্তি। ইতিবাচকতা ছড়িয়ে আমাদের ডা. রেহানা এবারও নীতির প্রশ্নে আপোষ করলেন না; আপোষ করলেন না তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে। একদম হন্য হয়ে তিনি ছুটতে লাগলেন প্রতিকূলতা পেরিয়ে ; শত বৈরিতাতেও পক্ষ নিলেন ন্যায়ের।
কিন্তু তারপর ? তারপরের কাহিনী জানতে আমার মতো আপনাদেরও অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছুদিন।
বাংলাদেশের সিনেমা হল, থিয়েটার কিংবা অন্য কোনো প্ল্যাটফর্মে সিনেমাটি এখনো মুক্তি পায় নি। তবুও আন্তর্জাতিক মাধ্যমগুলোতে হৈ চৈ কিংবা সমালোচকদের নজরকাড়া মন্তব্য প্রভৃতি থেকে সহজেই আঁচ করা যায় কতটা শ্বাসরুদ্ধকর এক যাত্রার সঙ্গী হবে এই চলচ্চিত্রের দর্শকেরা ।
ইউটিউবে মুক্তি পাওয়া ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ সিনেমাটির ট্রেইলারও যে এক অজানা রোমাঞ্চের হাতছানি দিচ্ছে সিনেমাপ্রেমীদের জন্য তা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে !
মানসিক যন্ত্রণায় ভোগা এক নারীর সাথে ঘটা অন্যায়ের প্রতিবাদে অন্য এক নারীর লড়াই, প্রতিষ্ঠানের সম্মান ক্ষুণ্ণ করা যাবে না- এই প্রতিজ্ঞায় বদ্ধপরিকর অপর এক নারীর তাতে বাধা প্রদান, একা হাতে সন্তান ও ক্যারিয়ার সামলানোর সংগ্রামে লিপ্ত এক হার না মানা যোদ্ধা; সব মিলিয়ে সমাজের ভিন্ন ভিন্ন সব পর্যায় থেকে আসা বিচিত্র সব নীতিবোধ সম্পন্ন নারীদের মাঝের টানাপোড়েনের এক অনবদ্য চিত্রায়ন হয়েছে চলচ্চিত্রটির আদ্যোপান্তে । আছে মানসিক অস্থিরতা, আছে অসহ্য যন্ত্রণা, আছে প্রাতিষ্ঠানিক নোংরা রাজনীতির জীবন্ত চিত্র। এক সংগ্রামী নারীর চলার পথে আসা হাজারো বাধা বিপত্তি পেরিয়ে নীতির প্রশ্নে আপোষহীন থাকার আপ্রাণ চেষ্টার এক রোমাঞ্চকর অধ্যায় ‘রেহানা মরিয়ম নূর’। নিখুঁত চিত্রায়ন আর অনিন্দ্য সুন্দর উপস্থাপনায় নিদারুণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন চলচ্চিত্র পরিচালক আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ।
সাড়া জাগানো সিনেমাটির পরিচালক আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ সম্পর্কে না বললে অন্যায় হয়ে যাবে। । অসম্ভব প্রতিভাবান এই মানুষটির পরিচালক হিসেবে এটি দ্বিতীয় কাজ। বলা বাহুল্য, তাঁর প্রথম কাজ ছিলো ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’। ২০১৬ সালে সিঙ্গাপুর আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রিমিয়ার হয়েছিলো সেই ডকু-ফিল্মটির৷ হৈ চৈ আর কি কম হয়েছিল সেখানেও? সিলভার স্ক্রিন অ্যাওয়ার্ডে ‘সেরা পরিচালক’ হিসেবে পুরষ্কার পান তিনি। ফিল্মটির বিশ্ব পরিবেশনার দায়িত্বে ছিলো প্যারিস ভিত্তিক স্বাধীন চলচ্চিত্রের বিপণন সংস্থা ‘স্ট্রে ডগ’।
৭ই জুলাই বুধবার প্যারিসের বিখ্যাত পালে দে ফেস্টিভ্যাল ভবনের সাল ডেবুসি প্রেক্ষাগৃহে জমায়েত হয়েছিলো বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা চলচ্চিত্র নির্মাতা, প্রযোজক, কলা-কুশলী, সমালোচক, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন মিডিয়া-কর্মীরা । উদ্দেশ্য কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের ৭৪তম আসরে ‘আঁ সাতেঁ রিগা’ নামক মহাগুরুত্বপূর্ণ বিভাগে আসা বাংলাদেশের একটি চলচ্চিত্র দেখা। এই ‘আঁ সাতেঁ রিগা’ বিভাগে অংশগ্রহণ করা সিনেমাগুলো উৎসবের প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান অর্জন করার জন্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে।
পাঠকদের সাথে গল্পে গল্পে আর রোমাঞ্চে রোমাঞ্চে নিজেরই হারিয়ে যাবার দশা ! কোথায় যেন ছিলাম ? ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। তো যা বলছিলাম! প্রদর্শনী শুরুর আগে উপস্থাপক মঞ্চে আমন্ত্রণ জানালেন পরিচালক আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ এবং সিনেমার নাম ভূমিকায় অভিনয় করা অভিনেত্রী ডা. আজমেরী হক বাঁধনকে। পরিচালক সাহেব মঞ্চে গিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ব্যক্ত করলেন তাঁর মনের কথা; কানে যে এসেছেন এটা তাঁর বিশ্বাস হচ্ছে না। অবিশ্বাসের সরলতা লুকোনোর চেষ্টাও তিনি করলেন না; স্পষ্ট ছাপ ছিল তাঁর চোখেমুখেও।
প্রসঙ্গত, পাঠকদের একটি তথ্য জানানোর করার লোভ সামলাতে পারছি না। ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ প্রথম কোনো বাংলাদেশি চলচ্চিত্র যা কি না কান চলচ্চিত্র উৎসবের মতো মর্যাদাপূর্ণ আসরে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচিত হয়েছে। কি গর্বের একটি বিষয়, তাই না? এই অর্জন আর সম্মান কিন্তু আমাদের সবার জন্যই !
কী যেন বলছিলাম.. আচ্ছা ! তারপর স্থানীয় সময় সকাল ১১টা ১৫ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় বিকাল ৩টা ১৫ মিনিট) শুরু হয় রেহানার সঙ্গে হলভর্তি চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের ১ ঘন্টা ৪৭ মিনিটের অভূতপূর্ব এক যাত্রা। চলচ্চিত্রে থাকা আমাদের বাংলা ভাষা হয়তো তাঁরা সবাই বোঝেননি। তবে সাবটাইটেলের বদৌলতে চলচ্চিত্রায়নের কলা-কৌশল ঠিকই ধরতে পেরেছেন; প্রদর্শনী পরবর্তী তাঁদের অভিব্যক্তিই ইঙ্গিত দিচ্ছিলো এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার। ।
আবারও বলছি, সিনেমাটি পুরোপুরি দেখার সৌভাগ্য এখনো হয় নি । তাই এখনও নিশ্চিত নই শেষ পর্যন্ত কী চিত্রিত হয়েছিলো অভিনেতা-অভিনেত্রীদের পরিবেশনায়।
তবে হল কানায় কানায় পরিপূর্ণ করে রাখা দর্শকদের অভিব্যক্তি, উল্লাস, হর্ষধ্বনি ও দাঁড়িয়ে সম্মান দেখানোর (স্ট্যান্ডিং ওভেশন) বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও ক্লিপ দেখেছি আমি। দেখেছি অভিনেত্রী বাঁধনের আনন্দে কেঁদে ফেলা বেসামাল কান্না। পরিচালক আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের তাঁকে ধাতস্থ করার আবেগময় ব্যর্থ চেষ্টা করে যাওয়া। আর সেখানে উপস্থিত হওয়া মুভিটির গোটা টিমকে ঘিরে মন্ত্রমুগ্ধ দর্শকদের দাঁড়িয়ে থেকে কানফাটানো শব্দে হাততালি দিয়েই যাওয়া; দিতেই থাকা.. !
আর সে দৃশ্য দেখে অভিনেত্রী বাঁধনের সাথে সাথে আমারও চোখ ভিজে আসছিলো বারবার।
তবে আমার কান্না আনন্দের নয়, গর্বের। অদ্ভুত এক গর্ববোধ হচ্ছিল প্রায় হতাশা আর মহামারীতে ডুবে যাওয়া আমার দেশটার প্রতি।
কেন, জানেন? কারণ আমাদের দেশকে বিশ্ব দরবারে মাথা তুলে দাঁড় করানোর সুযোগ করে দেওয়ার জন্য আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ, আজমেরী হক বাঁধনের মতো মানুষেরা এখনও আছেন। আছেন চমৎকার কিছু শিল্পী আর কলা-কুশলীরা।
আপনি প্রতিবাদ করে ওঠার আগেই স্বীকার করছি, অন্য অনেক ক্ষেত্রে আরও অনেকেই আছেন। কিন্তু আজ তাঁদের কথা নয়। আজ স্রেফ ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ এর দিন।
শেষ করছি একটি ক্ষুদে বার্তা দিয়ে।
প্রিয় বাঁধন আপু, অনেক অনেক শুভ কামনা ও অভিনন্দন আপনাকে৷ অভিনন্দন আপনার অসাধারণ কাজ করার ক্ষমতাকে। আমি প্রার্থনা করি, একদিন ‘রেহানা’ এর মতো অসংখ্য নীতিবান, দৃঢ়চেতা ও অন্যায়ের প্রতিবাদকারীরাই বদলে দেবে আমাদের দেশকে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই থাকবে সেই দলে; থাকবে না কোন ভেদাভেদ। থাকবে স্রেফ প্রতিবাদমুখর সচেতনতা। দুর্বলের পক্ষে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে।
আর সাদ ভাইয়া, গ্রেট জব!
ওয়ান মোর, প্লিজ ?
আর হ্যাঁ, আমাদেরও দেখার সুযোগ করে দিন তাড়াতাড়ি। তর সইছে না মোটেও..!
এক নজরে রেহানা মরিয়ম নূর
নাম: রেহানা মরিয়ম নূর (২০২১)
অভিনয়ে: আজমেরী হক বাঁধন, আফিয়া জাহিন জাইমা, কাজী সামি হাসান, আফিয়া তাবাসসুম বর্ণ, ইয়াছির আল হক, সাবেরি আলম প্রমুখ।
পরিচালক: আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ।
চিত্রনাট্য ও সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ।
প্রযোজক: জেরেমি চুয়া।
চিত্রগ্রাহক: তুহিন তমিজুল।
পরিবেশক: ফিল্ম বুটিকস।
_________________________________________________________________
Featured Image: Film’s Facebook page
References:
- Rehana Maryam Noor Official Trailer 2021
- Trailer for “Rehana Maryam Noor” out now
- ‘Rehana’: Cannes Review
- ওয়াও রেহানা মরিয়ম নূর ওয়াও
- ‘Rehana Maryam Noor’: Film Review | Cannes 2021
- অবশেষে দেশে মুক্তি পেল ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’
- কান উৎসবে আনন্দে কাঁদলেন বাঁধন, করতালির ঢেউয়ে ভাসলেন নির্মাতা সাদ | Rehana Maryam Noor at Cannes