দেশে দেশে কুসংস্কার

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ pexels.com এবং Meruyert Gonullu

চোখটা বন্ধ করে একটু ছোটবেলায় ঘুরে আসবেন কি ? প্রথম লাইনে এরকম উদ্ভট কথা শুনে ঘাবড়ে যাবেন না,প্রিয় পাঠক! চলুন না ঘুরে আসি ছোটবেলা থেকে। ছোটবেলার প্রসঙ্গ আসলেই গল্পে গল্পে সাজানো এক সময়ের কথা কমবেশি সবার-ই মনে পড়ে যায়। বড়দের কাছ থেকে গল্প না শুনে ঘুমানোর কথা তো অনেকে আমরা চিন্তাই করতে পারতাম না সে সময় ! গল্পের পাশাপাশি কুসংস্কারও শুনি নি এমন কেউ কি আদৌ আছে আমাদের মাঝে ? ছোটবেলা থেকে অনেকেই আমরা বড় হয়েছি বিভিন্ন কুসংস্কার নিয়ে শুনতে শুনতে। যেমন, রাতের বেলা নখ কাটলে বেজি কামড়ে দেয় কিংবা এক গালে চড় খেলে বিয়ে হয় না।

এরকম জানা অজানা নানা ধরনের কুসংস্কার যে শুধু বাংলাদেশেই আছে; তা কিন্তু নয়। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশে এখনো প্রচলিত আছে এরকম অদ্ভুত সব কুসংস্কার সমাচার। হরেক দেশের হরেক মানুষ এমন হরেক কুসংস্কার যে শুধু বিশ্বাস করে তা-ই নয়, বরং তা বয়ে চলেছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। কিছুক্ষণ আগেই ছেলেবেলা থেকে ঘুরে আসা পাঠকদের নিয়ে যদি এবার বিশ্বের আনাচে কানাচে ঘুরতে বের হই, তাহলে কি পাঠক সমাজ ক্লান্ত হবেন ? চলুন না ঘুরতে বেরিয়ে পড়ি পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে মজাদার সব কুসংস্কারের খোঁজে।

কাঠের গায়ে ঠকঠক করা

বহুল পরিচিত এই কুসংস্কারটির উৎপত্তি ব্রিটিশ কোনো এলাকায়, খুব সম্ভবত সেল্টিকে; মতান্তরে ইন্দো-ইউরোপীয় কোনো অঞ্চলে।

সেল্টিকের বাসিন্দারা বিশ্বাস করে যে, কাঠের গায়ে ঠকঠক করে আঘাত করলে খারাপ শক্তি থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব ; ছবি কৃতজ্ঞতাঃ freesoundslibrary.com

এই কুসংস্কারের উঠে আসার গল্পটা অঞ্চলভেদে বিভিন্ন রকম হলেও মূল গল্পটা কিন্তু এক। ইন্দো-ইউরোপিয়ান কিংবা সেল্টিক বিশ্বাস অনুযায়ী, যেকোনো গাছেই ভালো কিংবা খারাপ দুই ধরনের আত্মাই বসবাস করে থাকে। যেহেতু গাছ এই আত্মাদের আবাসস্থল, তাই তারা বিশ্বাস করে গাছের গায়ে ঠকঠক করে আঘাত করার মাধ্যমে সেই আত্মাকে তাড়িয়ে দেয়া সম্ভব। আর আত্মা ভালো হলে নিজের নিরাপত্তার জন্য সেই আত্মাকে ডেকেও আনা সম্ভব। ইতিহাসবিদদের মতে, এই কুসংস্কার এসেছে ১৯ শতকে ব্রিটেনের ছোট বাচ্চাদের খেলা থেকে; যার নাম ‘টিগি টাচউড’। এই খেলার নিয়ম অনেকটা এরকম যে, খেলোয়াড়দের সবচেয়ে কাছে থাকা গাছটি ছুঁয়ে তার কাছে ইমিউনিটি চাইতে হবে। ছোট শিশুদের এই খেলা পরবর্তীতে বড়দের জন্য অভ্যাস হয়ে যায় এবং একটি কুসংস্কারে পরিণত হয়।

বিভিন্ন দেশে এই কুসংস্কার ভিন্ন রূপে রয়েছে। ইতালিয়ানরা গাছের পরিবর্তে লোহা ছুঁয়ে দেয়,আরো ভালোভাবে বলতে গেলে লোহার তৈরি ঘোড়ার খুর। পোলিশ এবং রাশিয়ানরা এই ক্ষেত্রে ব্যবহার করে রংহীন কাঠ।

কাঁধের উপর দিয়ে পিছনে লবণ ছুঁড়ে মারা

গাছের গায়ে আঘাতের মতো এই কুসংস্কারটাও অনেক দেশেই প্রচলিত রয়েছে। পূর্বের ন্যায় এই কুসংস্কারের উদ্দেশ্যও খারাপ শক্তির হাত থেকে রেহাই পাওয়া, আরও ভালোভাবে বললে খোদ শয়তানের হাত থেকে।

                              কাঁধের উপর দিয়ে পিছনে লবণ ছুঁড়ে মারা ; ছবি কৃতজ্ঞতাঃ sandburg.org

কিংবদন্তি ইতালীয় চিত্রশিল্পী লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি’র ‘দ্যা লাস্ট সাপার’ চিত্রকর্মে জুডাস ইস্ক্যারিওটকে ভুলবশত লবণ ফেলে দিতে দেখা যায়। এখান থেকেই মূলত এই কুসংস্কারের উৎপত্তি। কথিত আছে, জুডাস তার কুকর্মের আগে নিজের পেছনে কাঁধের উপর দিয়ে লবণ ছুঁড়ে মেরেছিল যাতে তার পেছনে থাকা শয়তানের চোখ কিছুক্ষণের জন্য অন্ধ হয়ে যায় এবং সে নির্বিঘ্নে খারাপ কাজ করতে পারে।

এই কুসংস্কারটিও একেক দেশে একেক রকম। এই কুসংস্কারের ‘ওল্ড স্ক্র্যাচ’ নামে একটি ভার্শনে মানুষ বিশ্বাস করে, শয়তান মানুষের অনিষ্ট করার উদ্দেশ্যে বাম কাঁধের ঠিক পিছনেই থাকে। লবণ ছুঁড়ে মেরে এভাবে শয়তানকে তাড়ানো যায় বলেই তাদের বিশ্বাস। রোমানদের মতে, পিছনে লবণ ছুঁড়লে দুর্ভাগ্যের হাত থেকে বাঁচা যায় কিংবা আসন্ন কোনো দুর্গতির হাত থেকেও রেহাই পাওয়া যায়।

ফ্রাইডে দ্য থার্টিনথ

রোমানরা ৭ সংখ্যাটিকে যেমন সৌভাগ্যের প্রতীক মনে করে, ঠিক তেমনিভাবে ১৩ কে তারা বিবেচনা করা অপয়া হিসেবে। এই সংস্কৃতির উৎপত্তি মূলত ইউরোপে, বিশেষ করে খ্রিস্ট ধর্ম থেকে। এই ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে ১২ সংখ্যাটিকে ধরা হয় পজিটিভ হিসেবে। কারণ খ্রিস্ট ধর্মে ১২ একটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ সংখ্যা (বছরে ১২ মাস, ১২টি রাশি, ক্রিসমাসের ১২ দিন)। কিন্তু এর পরের সংখ্যা ১৩ কে তারা দেখে দুর্ভাগ্য হিসেবে।

                                                        ফ্রাইডে দ্য থার্টিনথ; ছবি কৃতজ্ঞতাঃ HBO Max

যিশু খ্রিস্টের ‘দ্য লাস্ট সাপার’ অর্থাৎ তার শেষ ভোজে ১৩তম ব্যক্তি ছিল জুডাস ইস্ক্যারিওট। এই বিশ্বাসঘাতক জুডাসের কুকীর্তিতেই সেদিন যিশু খ্রিস্টকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয় বলে খিস্টানদের বিশ্বাস।[ যদিও ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস অনুসারে, যিশু খ্রিস্ট বা হজরত ঈসা(আ)কে সেদিন ক্রুশবিদ্ধ করা হয় নি,বরং আল্লাহ তাঁকে স্বীয় অনুগ্রহে আসমানে উঠিয়ে নিয়ে যান। তাঁর স্থলে সেই বিশ্বাসঘাতক জুডাসকে আল্লাহ অবিকল ঈসা(আ)-এর মত চেহারা দান করেন, ফলশ্রুতিতে তাকে হজরত ঈসা (আ) বা যিশু খ্রিস্ট ভেবে ক্রুশবিদ্ধ করা হয় ]। এই ঘটনার পর থেকে ১৩ কে দুর্ভাগ্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করে খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীরা। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী যদি কোনো মাসের ১৩তম দিন শুক্রবার পড়ে, তবে সেই দিনটিকে অপয়া হিসেবে ধরে নেয় তারা।

রাতের বেলা চুইংগাম

ছোটবেলায় হয়তো বেশি চুইংগাম খাওয়া নিয়ে বাবা-মায়ের অনেক বকুনি শুনেছেন। দাঁতের জন্য ক্ষতিকর, পেটে গেলে ক্ষতি হবে- আরও কত কি!  তবে এ চুইংগামের ব্যাপারে অন্য সবার চেয়ে আরও কয়েক কদম এগিয়ে তুরস্কের লোকজন। তুর্কিতে রাতের বেলায় চুইংগাম চাবানো নিষেধ। তারা বিশ্বাস করে নিরীহ চুইংগাম রাতের বেলা মৃত মানুষের মাংসতে পরিণত হয়। এ কারণে রাতের বেলা চুইংগাম খাওয়া থেকে বিরত থাকতে বলা হয় সেখানে।

এই কুসংস্কারটির কোনো উৎপত্তির ব্যাপারে জানা যায়নি। তারপরও কি দরকার ঝুঁকি নেয়ার!

অপয়া চার

ইউরোপিয়ানরা যেমন ১৩ কে অপয়া হিসেবে মনে করে, ঠিক তেমনি চায়নাতেও তারা ৪ সংখ্যাটিকে দুর্ভাগ্য আনয়নকারী বলে মনে করে।

চাইনিজ ভাষায় চার এবং মৃত্যুর সাদৃশ্য; ছবি কৃতজ্ঞতাঃ yoyochinese.com

তারা চার সংক্রান্ত যেকোনো কিছু এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। এমনকি হোটেলে চারতলা কিংবা চার সংখ্যা আছে এমন রুম নম্বরও এড়িয়ে চলতে চায় তারা। কিন্তু কেন? চাইনিজ ভাষায় চার শব্দটির উচ্চারণ অনেকটাই মিলে যায় চাইনিজ ভাষায় উচ্চারিত মৃত্যুর সঙ্গে। এ কারণে চাইনিজ মানুষজন চার সংখ্যাটিকে অপয়া হিসেবে বিবেচনা করে।

কবরস্থানের মধ্যে বুড়ো আঙ্গুল গুঁজে রাখা

চাইনিজদের মৃত্যুর ভয়ে চার এড়িয়ে চলার মতই অনেকটা এই কুসংস্কারটি। এর প্রচলন রয়েছে জাপানে। জাপানিরা যখন নিজের কোনো মৃত স্বজনের কবর দেখতে যায়, তখন তারা নিজেদের বুড়ো আঙুল নিজের মুষ্টিতে গুঁজে রাখে। এর কারণটাও অবশ্য সেখানে স্বাভাবিক।

বুড়ো আঙুলকে জাপানে বলা হয় ‘প্যারেন্ট ফিঙ্গার’। নাম শুনেই হয়ত অনেকটা আঁচ করতে পারছেন বিষয়টি। জাপানিরা কবরস্থানে গেলে নিজেদের বুড়ো আঙুল গুঁজে রাখে এই বিশ্বাসে যে, এর ফলে তাদের বাবা-মায়েরা মৃত্যুর হাত থেকে নিরাপদে থাকবে।

মাটি থেকে দূরে থাকবে ওয়ালেট

দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ব্রাজিলের লোকজন বিশ্বাস করে যে, নিজেদের ওয়ালেট বা মানিব্যাগ মাটিতে ফেলে রাখা মানে নিজেদের অর্থনৈতিক দুরাবস্থা ডেকে আনা। ওয়ালেট মাটিতে পড়া মানে দুর্ভাগ্য অতি নিকটে বলেই প্রচলিত বিশ্বাসে তারা বিশ্বাসী। ফিলিপাইন এবং লাতিন আমেরিকান অনেক দেশই এই কুসংস্কারে বিশ্বাস করে।

চায়নাতেও এই কুসংস্কারের প্রচলন আছে। এ বিষয়ে তাদের প্রচলিত কথাটি অনুবাদ করলে এর মানে দাঁড়ায় অনেকটা এমন, “মানিব্যাগ মাটিতে মানে টাকা ঘরের বাহিরে”। তারা বিশ্বাস করে, এতে অর্থের প্রতি অসম্মান করা হয়।

এ ব্যাপারটাকে একেবারে কুসংস্কারও বলা যায় না। আপনি টাকা মাটিতে ফেলে রাখলে, দুর্বৃত্তরা যে এর ফায়দা লুটবে না তার নিশ্চয়তা কি?

হলুদ ফুল

ভালবাসা দিবস কিংবা যে কোনো বিশেষ দিনে হয়তো প্রেয়সীকে গোলাপ ফুল দেন আপনি। একদিন হয়তো ভাবলেন, “সবসময় তো গোলাপ দেই, এবার না হয়  অন্য কিছু দেই!”। নিয়ে গেলেন হলুদ রঙের অন্য কোনো ফুল।

হাতে নিয়ে হলুদ ফুল ; ছবি কৃতজ্ঞতাঃ pixels.com

প্রেমিকা বাঙালি হলে তেমন সমস্যা হবার কথা নয়। কিন্তু ব্যাপারটা যদি ঘটে রাশিয়াতে, তবে আপনার কপালে দুঃখ থাকতে পারে । কেন? কারণ রাশিয়াতে হলুদ ফুল হলো বিচ্ছেদ, অবিশ্বাস এবং মৃত্যুর প্রতীক। একারণে রাশিয়ার মানুষজন নিজের প্রিয় মানুষকে হলুদ ফুল দেয়া থেকে বিরত থাকে।

অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া থেকে যেতে পারবেন না ঘরে

ফিলিপাইনে এই কুসংস্কারটিকে টেগালগ ভাষায় বলা হয় ‘পাগপাগ’, যার অর্থ ময়লা ঝেড়ে নেয়া। ফিলিপাইন সংস্কৃতি অনুযায়ী, আপনি কারো অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া থেকে সরাসরি বাড়ি ফিরতে পারবেন না। তার মানে কি কারো শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে গেলে বাকি জীবন আপনাকে ঘরের বাহিরেই কাটাতে হবে? না, ব্যাপারটা আসলে এমন নয়। ফিলিপিনোরা বিশ্বাস করে, কারো শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে উপস্থিত হলে মৃত ব্যক্তির বিদেহী আত্মা আপনাকে অনুসরণ করে। তাহলে এর থেকে রেহাই পাওয়ার উপায় কি? এর জন্য আপনি বাড়ি যাওয়ার আগে অন্য কোথাও থেকে ঘুরে আসবেন, সেটা হতে পারে স্টারবাকস, ম্যাকডোনাল্ডস কিংবা কেএফসি। এর পিছনে যুক্তি হলো মৃতের আত্মা বা অন্য যে কোনো আত্মা যেন ঘরে না ঢুকতে পারে, এজন্য আগে অন্য জায়গা হয়ে ঘুরে আসতে পারে।

কত কুসংস্কার ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিশ্বের আনাচে কানাচে, আমরা তার কতটুকুই বা জানি। বিষয়টি কি বিস্ময়ের উদ্রেক করে না ?


This is a Bangla article about superstitions around the world.

Featured Image : Meruyert Gonullu , pexels.com 

Reference:

Related Articles

অন্যান্য
Sirajul Islam Mozumder

পিকি ব্লাইন্ডার্সঃ বিংশ শতাব্দীতে বার্মিংহামের রাস্তা দাপিয়ে বেড়ানো এক দস্যুদল

“বাই দি অর্ডার অব পিকি ব্লাইন্ডার্স”। আপনি যদি সিরিজপ্রেমী হয়ে থাকেন, তবে এই বাক্যটির সাথে

বিস্তারিত »
সোশ্যাল মিডিয়া
পাঠক প্রিয়
খেলা
ফেইসবুক পেজ