“রইবো না-কো বদ্ধ খাঁচায়, দেখবো এ-সব ঘুরে-আকাশ, বাতাস, চন্দ্র, তারায়, সাগর জলে, পাহাড় চুঁড়ে।আমার সীমার বাঁধন টুটেদশ দিকেতে পড়বো লুটে।পাতাল ফেরে নামবো নিচে, উঠবো আবার আকাশ ফুঁড়ে,বিশ্ব জগৎ দেখবো আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে।“
বিশ্ব জগতের কতটা আমাদের জানা আর কতটা জানার বাইরে তার হিসেব হয়তো আজকাল যান্ত্রিকতার টানাপোড়েনে ভুলতেই বসেছি আমরা। মাঝে মাঝে হুটহাট হয়তো ইচ্ছা হয় কী আছে এখানে? রহস্যের কতটা অজানা তার সুতো ধরে টান দিলে হয়তো মণের পর মণ ওজন পাবো তবে তাতে কি হয়? আদতে না। বিশ্ব জগতের অজস্র রহস্যের এক টুকরো নিয়ে হাজির হয়েছি আজ। আলাপনের বিষয়- ” দ্য গ্রেট ব্লু হোল”।
……
ব্ল্যাক হোলের সাথে নামের মিল দেখে ‘দ্য গ্রেট ব্লু হোল’কে যারা মহাজাগতিক কোন রহস্য কিংবা অতি-প্রাকৃতিক কিছু ভাবছেন, তাদের উদ্দেশ্যে বলে রাখছি আদতে ‘দ্য গ্রেট ব্লু হোল’ এর অস্তিত্ব আমাদের এ পৃথিবীতেই। ডুব সাতারের জন্য জায়গাটি সারা বিশ্বে বেশ জনপ্রিয় এবং পরিচিত। এতটা জনপ্রিয় এবং পরিচিত জায়গাটির নামকরণ, উৎপত্তির রহস্য আর কী আছে সেখানে এগুলো জানাতেই আজকের নিবন্ধনে থাকছে ‘দ্য গ্রেট ব্লু হোল’ এর আদ্যপান্ত।
……।।
‘দ্য গ্রেট ব্লু হোল’ এর একটুখানি পরিচয়
বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো নীল গহ্বর; ©upscalelivingmag.com
কেউ বলেন বেলিজ, কেউ বা বিলিজ। তবে ক্যারাবিয়ান দেশ বাহামার বেলিজ কিংবা বিলিজ উপকূলে অবস্থিত সমুদ্র গর্ভস্থ একটি গর্তের নাম ‘দ্য গ্রেট ব্লু হোল’। মূলত বিশাল কেভ নেটওয়ার্ক এর প্রবেশদ্বার বলা হয় ‘দ্য গ্রেট ব্লু হোল’ কে যা বেলিজ কিংবা বিলিজের বেরিয়ার রিফ রিজার্ভ সিস্টেমে অবস্থান করে। তবে এটা বেলিজ কিংবা বিলিজ সিটি থেকেও আরও প্রায় ৬০ মাইল দূরে উপকূলবর্তী এক প্রবাল প্রাচীরের কেন্দ্র ঘিরে অবস্থিত। এই প্রবাল প্রাচীর নিয়ে একটি কথা সংযোজন না করলেই নয়, ইউনেস্কো কর্তৃক এই প্রবাল প্রাচীর ওয়ার্ল্ড হেরিটেইজ সাইট হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে ১৯৯৬ সালে। এছাড়াও, বেলিজ কিংবা বিলিজের বিখ্যাত ৭টি প্রবাল প্রাচীরের মধ্যে লাইটহাউজ নামক এক প্রাচীরের কেন্দ্রেই অবস্থান এর।
‘দ্য গ্রেট ব্লু হোল’: নাম রহস্য ও এর আয়তন
গহীন নীলের দুনিয়া; ©newsweek.com
নীল সে রাজ্য। হঠাৎ তাকালে মনে হবে, স্রষ্টা যেন নিখুঁত কিছু নীল ঢেলে সাজিয়ে রেখেছেন জায়গাটুকু। সে নীল আবার যে-সে নীল নয়, একদম নীল অপরাজিতার সবটুকু উপচে দেওয়া নীল। রঙের কারণেই নামকরণ হয়েছে ‘ব্লু হোল’। সমুদ্রের সবুজাভ পানি থেকে ‘দ্য গ্রেট ব্লু হোল’ এর পানিকে আলাদা করা যায় খুব সহজেই। তবে এর পুরো নামের রহস্য একটু আলাদা। সমুদ্রের ভেতরে যে গর্ত থাকে, সে তো কমবেশি সবারই জানা। কোন কোন গর্ত এতই ছোটো যে ক্ষুদ্রাকৃতির প্লাঙ্কটনেরা ওতে দিব্যি বাসা বানিয়ে থাকে, আবার কোন কোনটি এতটাই বড়ো যে হাঙর কিংবা ভয়ংকর সব দানবীয় স্কুইড আর অক্টোপাসেরা মিলে ওসব গর্তকে নিজেদের অভয়াশ্রম বানিয়ে ফেলে। এদিক থেকে ‘দ্য গ্রেট ব্লু হোল’ এর হিসাব একটু আলাদা। কতটা আলাদা, সে প্রশ্ন যদি জিজ্ঞাসা করেন তবে বলতে হবে বিশ্বের বৃহত্তম সমুদ্র গর্ত হিসেবে স্বীকৃত এই ‘দ্য গ্রেট ব্লু হোল’। বৃত্তাকার আকৃতির এই হোলের ব্যাসার্ধ ৩০০ মিটার বা ৯৮৪ ফুট এবং গভীরতা ১২৪ মিটার বা ৪০৭ ফুট।
‘দ্য গ্রেট ব্লু হোল’ এর উৎপত্তির রহস্য
Image: Deeperlblue.com
আচ্ছা কখনও কি আপনাদের এমনটা মনে হয়েছে যে, পৃথিবীটা আগে কেমন ছিল দেখতে? এতটাই সবুজে ভরপুর কিংবা নীল অথবা সবুজাভ সাগরে ঠেসে থাকা অবয়ব কি আদৌ ছিল? কেমন ছিল তবে?
ঠিক কত বছর কিংবা হাজার তা গুণে বের করা মুশকিল হলেও অনুমান করে বিজ্ঞানীরা বের করেছেন, ৬৫ হাজার বছর আগে এ পৃথিবীতে রাজত্ব করতো বরফ। তিন ভাগ জল আর এক ভাগ স্থলের এই পৃথিবীর ঐ বাকি তিন ভাগের পুরোটাই জমে জমা হয়েছিল মেরু অঞ্চলে। ভাবুন একবার- পুরো পৃথিবী জুড়ে বরফ, ঢেকে থাকা বরফ, সাগর কিংবা স্থল সবটা জুড়েই কেবল বরফ আর বরফ। ফ্রোজেন মুভির রাজকন্যাদের অনুভূতি বাস্তবে হচ্ছে কি?
……
তবে এখানে একটা বিষয় আছে। এখন আমরা সমুদ্রপৃষ্ঠকে যেমন ভূমির সমতল হিসেবে দেখি তখন কিন্তু এমন ছিল না। এখনের চেয়ে অনেক বেশিই নিচুতে অবস্থান করতো সমুদ্রপৃষ্ঠ গবেষণা অন্তত তাই জানাচ্ছে। আর বেলিজ কিংবা বিলিজে তখন সমুদ্রপৃষ্ঠ ছিল এখনকার অবস্থানের চাইতে আরও ১৫০ মিটার নিচুতে।
মূলত ক্যালসিয়াম কার্বনেট জাতীয় এক ধরণের শক্ত পদার্থ জমে তৈরি হয় এই পাথর। একেকটি পাথরের আকার হয় বিশাল। বিশাল সে আকৃতির পাথর দিয়ে সৃষ্টি হয় কেভের বিরাট কাঠামো। বরফের রাজত্বে গাছহীনতা, প্রাণহীনতা কিংবা কার্বন-ডাই-অক্সাইড অথবা সূর্যের তীব্র তাপ, যে কোন কারণে যখন বরফ গলতে শুরু করে তখনই বাড়তে থাকে সমুদ্রের পানির উচ্চতা এবং ডুবে যায় ক্যালসিয়াম কার্বনেটের সে শক্ত আস্তরের পাথর। আলাপনের শুরুতে যে কেভ নেটওয়ার্ক এর কথা বলেছি, ধারণা করা হচ্ছে এটিও ১৫ হাজার বছর আগে পানির নিচে ডুবে যায় এবং কারণ হিসেবে বরফ গলে সমুদ্রের পানি বেড়ে যাওয়াকেই দায়ী করা হয়। আর এই এই ডুবে যাওয়া কেভ নেটওয়ার্ক এর কয়েকটি জায়গার পাথর ভেঙে সৃষ্টি হয় ‘দ্য গ্রেট ব্লু হোল’ নামক রহস্যের নীল জলের রাজ্য।
অদ্বিতীয় ‘দ্য গ্রেট ব্লু হোল’
প্রাকৃতিক খেয়ালে সৃষ্ট এ ‘ব্লু হোল’ টি আদতে অদ্বিতীয়। কারণ পৃথিবীতে আসলে যে কয়টি এমন ‘ব্লু হোল’ রয়েছে, ‘দ্য গ্রেট ব্লু হোল’ এদের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো। এখনও পর্যন্ত প্রথম স্থান ধরে রাখা এ স্থানটি ডিসকভারি চ্যানেলের “বিশ্বের সবচাইতে অভূতপূর্ব জায়গা”র যে তালিকা প্রকাশ করা হয় সে তালিকায় প্রথম স্থান দখল করে নিয়েছে ২০১২ সালে। অর্থাৎ আজ থেকে ৯ বছর আগে এই প্রথম স্থান অর্জন করেছে ‘দ্য গ্রেট ব্লু হোল’ এবং এখনও স্বমহিমায় একই স্থানে আছে। ট্রাভেলিং কিংবা ডাইভ অথবা সমুদ্রের নিচে থাকা রহস্য নিয়ে যাদের প্রবল আগ্রহ আছে তারা চাইলেই ঘুরে আসতে পারেন সামুদ্রিক প্রবাল, প্রাচীর এবং জলজ উদ্ভিদে ঘেরা এই হোলটিতে। হোলটির ভেতর পাবেন চেনা দুনিয়ার বাইরে আলাদা এক নীল জগৎ, যত গভীরে নামবেন আঁটকে যাবেন নীলের মায়ায়।
নীলের রাজ্য! ©oddviser
আশ্চর্যের বিষয় এই, বেশ কিছু আজব প্রাণির সন্ধান পাওয়া গেছে এই হোলে। এমন কিছু জলজ প্রাণির অস্তিত্বের খোঁজ মিলেছে যেগুলো বিজ্ঞানীদের কাছে একদমই নতুন। নতুন নতুন প্রাণি খোঁজার এ প্রক্রিয়া এখনও চলমান। সুতরাং সমুদ্র এবং রহস্য যারা ভালোবাসেন তারা কিন্তু ভ্রমণের তালিকায় রাখতেই পারেন এই অপার রহস্যে ঘেরা নতুন প্রাণের নীল জগৎ ‘দ্য গ্রেট ব্লু হোল’ কে।
…….
সমুদ্রের অতলে এই মহারহস্যকে কাছ থেকে দেখতে আপনাকে ডাইভিং জানতে হবে। অভিজ্ঞ ডাইভার ছাড়া দয়া করে কেউ ঝুঁকি নেবেন না। হোলের যত কাছে যাবেন, অর্থাৎ যত গভীরে নামবেন পানি ততই স্বচ্ছ আর পরিষ্কার হয়ে ধরা দেবে। স্পষ্ট দেখতে পাবেন প্রাচীরের জটিল থেকে জটিলতর গঠনগুলো। বিলিজ কিংবা বেলিজ বেরিয়ার রিফ রিজার্ভ সিটেমের একটি অংশ হলো এই ‘দ্য গ্রেট ব্লু হোল’ আর এত সৌন্দর্য দেখে ইউনেস্কোও যেন চাইছিল বিশ্ব জানুক এ বিশাল সৌন্দর্য সম্পর্কে। আর তাই, বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকায় এই বেরিয়ার রিফ তালিকাভুক্ত হয়েছে ইউনেস্কো কর্তৃক।
….
….
Reference:
Fascinating facts about the Great Blue HoleFascinating facts about the Great Blue Hole.
Feature Image: Derek law