কৈশোর ও যৌবনের পাঠক হৃদয়ের নস্টালজিয়া যেই সিরিজ গুলো, আজকে তুলে তুলে ধরব এমনই কিছু সিরিজের ব্যাপারে। একমাত্র যারা বই পড়ুয়া তারা এই লেখাটি পড়ে বার বার নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়বে। কারণ আমাদের ছোটবেলায় ছিলো না স্মার্ট ফোন বা আধুনিক যুগের মত তথ্য ও প্রযুক্তির উষ্ণ আর্দ্র স্পর্শ। হয়তো এজন্যই এই সকল সেরা সেরা সাহিত্য সিরিজের স্বাদ আস্বাদন করতে পেরেছিলাম, পেরেছিলাম শোবার ঘরের চার দেয়ালে আবদ্ধ হয়েও পৃথিবী ভ্রমণের রোম্যাঞ্চকর অভিযাত্রার সাক্ষী হতে। কখনো মা বাবার বকুনির ভয়ে পাঠ্যবইয়ে লুকিয়ে তিন গোয়েন্দা বা সাইমুম সিরিজ পড়েছেন? অথবা কাঁথার নিচে পেন্সিল টর্চ জ্বালিয়ে হ্যারি পটার? যদি এত সব আনন্দ আর উত্তেজনায় আপনার শৈশব কেটে থাকে তবে এই লেখাটা আপনার জন্যই। তো দেরি না করে চলুন না, আমরা কলম নামক সময়যন্ত্রে চড়ে অতীতে ফিরে যাই।
১. তিন গোয়েন্দা সিরিজ
প্রথমেই আসে যেই সিরিজের নাম, সেটাই রকিব হাসানের লেখা “তিন গোয়েন্দা সিরিজ”। তিন গোয়েন্দা নামের মাঝেই কমবেশি সবারই ক্লাসের পড়া ফাঁকি দেওয়ার মত নেশাতুর অতীত লুকিয়ে আছে। “তিন গোয়েন্দা” সিরিজের নাম শুনেই ধারণা করা যায় এটায় প্রধান চরিত্র নিশ্চিত তিনজন গোয়েন্দা। আসলেই তাই। গোয়েন্দা প্রধান কিশোর পাশা, নথি গবেষক রবিন মিলফোর্ড, এবং সহকারি গোয়েন্দা মুসা আমানকে নিয়েই এই পুরো সিরিজটা লেখা হয়েছে। তিনজন আবার তিন রকম স্বভাবের। এই যেমন ধরুন কিশোর পাশা, এই ছেলেটা বাংলাদেশি। তার মাথায় চাপে গোয়েন্দাগিরি করার ভুত। ব্যস দুজন সঙ্গিও জুটে গেল। মুসা আর রবিন। মুসা হচ্ছে আমেরিকান নিগ্রো। বিশালদেহী, ভোজনরসিক আর ইঞ্জিনের প্রতি নির্ভেজাল প্রেমে তার জীবন। সে আবার কারাতে ও জুডোও পারে। তিনজনের মধ্যে মুসার চরিত্রে লেখক যেন তার ঝুড়িতে থাকা সবটুকু সেন্স অব হিউমার ঢেলে দিয়েছেন। মুসার মুখ নিঃসৃত বিখ্যাত বাংলা শব্দ গুলো এমন, “ইয়াল্লাহ!” “খাইছে” এগুলো সে শিখেছে বাঙালি কিশোরের কাছ থেকে। ওদিকে রবিনটা আবার খাঁটি বই পোকা। যাকে কিশোর আর মুসা মজা করে চলতে ফিরতে জ্ঞানভাণ্ডার বলে ডাকে। রবিনের চরিত্রটাই এমন যেন সে এক জীবন্ত লাইব্রেরি। গোয়েন্দাগিরি চলাকালীন সব নথি লেখার আর পড়ার দায়িত্ব ওর হাতেই ন্যাস্ত থাকে। সে আবার খাটি আমেরিকান নয়। আইরিশ আমেরিকান।
“তিন গোয়েন্দা” সিরিজের আরও কয়েটা পার্শ্বচরিত্র রয়েছে যেগুলোর নাম না বললেই নয়। যেমন ফগর্যাম্পারকট, উনি একজন পুলিশ অফিসার। তিন গোয়েন্দার সাথে তার ব্যক্তিগত শত্রুতা নেই, তবুও তিনি কেন জানি তাদের নিজের চোখের বালি ভেবে বসে থাকে। আরেকজন হলো শুটকি টেরি চরিত্র। তিন গোয়েন্দাকে নানাভাবে হেনস্তা করা উত্ত্যক্ত করাই তার কাজ। রাশেদ পাশা আর মেরি চাচী এনারা দুজন পাঠকের মনে একটা অবিচ্ছেদ্য ভালোবাসা তৈরি করে নিয়েছে নিজেদের জন্য। সব মিলিয়ে কিশোর হৃদয়ে চির অস্নান হয়ে থাকবে “তিন গোয়েন্দা”, হয়তো হাজার বছর পরেও।
২. সাইমুম সিরিজ
আবুল আসাদের লেখা সাইমুম খুব যে আহামরি থ্রিলার বা সেরকম কিছু তা নয়। সাইমুমের একটা ব্যাপার আছে। যা হাজার ভুল থাকার পরেও কিংবদন্তি হবার যোগ্যতা রাখে। শ’য়ে শ পাওয়া থ্রিলার সাহিত্য বাংলাদেশে আছে। কিন্তু তবুও সাইমুম নিয়ে বলছি কারণ, সাইমুম হয়তো ভুলে ভরা, হয়তো আহামরি কিছু নয়, তবুও হাজার হাজার মানুষ পড়েছে, হাজার হাজার মানুষ ভালোবেসেছে এটা কিন্তু কম নয়।
সাইমুম, এটি বইয়ের মধ্যেকার একটা সংঠন। যার প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছে কেন্দ্রীয় চরিত্র আহমদ মুসা। আরও অনেক চরিত্র আছে, চরিত্র গুলোর অটল অবিচল থাকার ব্যাপারটা খুবই প্রসংশার দাবিদার। সাইমুম আসলে ইসলামি ভাবধারার একটা থ্রিলার সিরিজ। তাই এখানে এমন সব এলিমেন্ট আনার চেষ্টা করা হয়েছে যেগুলো ইসলামিক শরি’আর সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক নয়৷ তাই অনেক বাছ বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই সিরিজের এক একটা গল্প দাঁড়িয়েছে। সুতরাং দক্ষতার সাথে দুর্বল বা সবল উপাদানের সংমিশ্রণ ঘটেছে।
এটির সবচেয়ে বড় সার্থক দিক হচ্ছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাক্যের মধ্যে অনেক রকম ধর্মীয় বিধানের ব্যাপারে স্মরণ করিয়ে দেওয়া, ভুলে যাওয়া অনেক গুলো ভূখণ্ডের ইতিহাস গুলো স্মরণ করিয়ে দেওয়া। পাঠক হৃদয়কে সেই ইতিহাস, সোনালী অতীত ইতিহাস পাঠের জন্য উস্কে দেওয়া। শুধু মাত্র এইগুলির জন্য সাইমুমকে নিয়ে আসা। সব মিলিয়ে সেই সময়ের পটভূমিতে সাইমুম আসলেই অসাধারণ একটা সিরিজ।
৩. হ্যারি পটার সিরিজ
জে.কে. রাওলিংয়ের লেখা “হ্যারি পটার” সিরিজ কিশোরদে জন্য লেখা সেক্লুডেড ওয়ার্ল্ড ফ্যান্টাসি জনরার বই। “হ্যারি পটার” পাঠককে নতুন একটা স্বাদ দেয়। কারণ ফ্যান্টাসি জনরা বলতে বাংলাদেশের শতভাগ পাঠক একমাত্র “হ্যারি পটার”কেই চেনে এখনো। ম্যাজিক ওয়ান্ড, স্পেল, ড্রাগন, গ্রিফিন, ফিনিক্স, হগওয়ার্টস, মাগলস, এসব টার্মের ব্যাপারে পাঠক এখনো “হ্যারি পটারে”ই জানতে পারে। “হ্যারি পটারে” মোট সাতটি বই রয়েছে। যার প্রতিটি বইতেই আছে হ্যারি পটার নামক কেন্দ্রীয় চরিত্রের হগওয়ার্টস নামক জাদুবিদ্যার বিদ্যালয়ে সাতটি বছরের জীবন।
হ্যারি হচ্ছে অনাথ শিশু। এক পর্যায়ে সে জানতে পারে সে একজন জাদুকর। ব্যস, এবার জাদু শিখতে ভর্তি হয় হগওয়ার্টসে। এখানে এসে দুজন বন্ধুও জুটে যায় তার। একজন হচ্ছে হারমিয়ন আরেকজন হচ্ছে রন। হ্যারির আরেকজন বন্ধুও জুটে, সে কোন ছাত্র নয়, বরং সে হচ্ছে হ্যাগ্রিড। হ্যাগ্রিড হ্যারি, হার্মিয়ন, আর রনকে খুবই ভালোবাসতো। আবার কিছু শিক্ষক ছিল যারা হ্যারির পিতা মাতার মতই হ্যারির জন্য নিজেদের জীবন দিয়ে দিতেও প্রস্তুত ছিলো। পিতা মাতা হারানো অসহায় জীবনে বেড়ে ওঠা হ্যারি যখন হগওয়ার্টসে এসে এরকম দারুণ পরিবেশ পেল, তখন হগওয়ার্টস যেন ওর পরিবার হয়ে গেল। তো এই রকম একটা পরিবেশে কাটতে থাকে হ্যারির শিক্ষাজীবন। কিন্তু সবার মত হ্যারির জীবনেও নেমে আসে কঠিন সময়। “হ্যারি পটারে”র কুখ্যাত চরিত্র লর্ড ভল্ডেমর্টের আগমন তার শিক্ষাজীবনের প্রতিটি অধ্যায়কে দুর্বিষহ করে তুলতো। কিন্তু কঠিন অধ্যাবসায় আর সততা, সেই সাথে সকলের ভালোবাসা প্রতিবারই হ্যারিকে ভভল্ডেমর্টের হাত থেকে রক্ষা করেছে।
৪. গেইম অব থ্রোনস সিরিজ
এই সিরিজটি লিখেছেন জন আর আর মার্টিন। বেশ জনপ্রিয় এই সিরিজটি আপনাকে নিয়ে যাবে এমন এক কাল্পনিক দুনিয়ায় যেখানে আছে ডাইনি, ড্রাগন, জীবন্মৃত, আরও অনেক রোমাঞ্চ, আর একটা লৌহ সিংহাসন। যেই জগতে আছে পদে পদে মৃত্যুর হাতছানি। হ্যাঁ “গেইম অব থ্রোনস” একটা লো ফ্যান্টাসি জনরার উপন্যাস সিরিজ। এই সিরিজের রয়েছে মোট সাতটি বই। যার প্রথম বইটি বাংলায় অনুদিত হয়েছে। এছাড়া এই সিরিজ নিয়ে তৈরি হয়েছে বলিউডের ড্রামা সিরিজও। যা বিভিন্ন দেশে প্রচারিত হয়।
“গেইম অব থ্রোনস” সিরিজ বই এজন্য এতে আছে অসংখ্য চরিত্র। সেই চরিত্রের মাঝে আছে রাজনীতি, যুদ্ধ, দ্বন্দ্ব, ফাঁসাদ, ক্ষমতার লড়াই, দম্ভ, অর্থাৎ একটা লো ফ্যান্টাসি ওয়ার্ল্ড বিল্ডয়াপ করে এত এত ঘটনার সন্নিবেশ ঘটানো সত্যিই প্রসংসার দাবি রাখে। প্রতিটি চরিত্র আলাদা আলাদা স্বকীয়তার মধ্য দিয়ে উত্থান পতন হয়েছে। এই সিরিজ যদিও খুব বেশি পুরনো নয়৷ কিন্তু তবুও একজন বই পড়ুয়া হয়ে থাকেন, ফ্যান্টাসি জনরা পছন্দ করে থাকেন তাহলে এই সিরিজটি আপনার অবশ্যই পড়া উচিত।
৫. ক্রুসেড সিরিজ
এনায়েতুল্লাহ আলতামাশের লেখা সেরা সিরিজটি হলো “ক্রুসেড সিরিজ”। এটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন লেখক আসাদ বীন হাফিজ। যারা সাইমুম পড়েছে, আমার মনে হয় তার আশি শতাংশ পাঠক “ক্রুসেড সিরিজ”ও পড়েছে। পড়বে না-ই বা কেন? “সাইমুম সিরিজ” তো কাল্পনিক গল্প। কিন্তু ক্রুসেড যে একটা জলজ্যান্ত ইতিহাসের নাম। একটা বিজয় ইতিহাসের নাম। বীর যোদ্ধা সুলতান সালাউদ্দিন আইয়্যুবির নাম। যদিও এতেও অনেক ফিকশনাল চরিত্র রয়েছে, তবুও ক্রুসেড শব্দটা কানে আসলেই আমাদের মুসলিম বীর সালাউদ্দিন আইয়্যুবির কথা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
“ক্রুসেড সিরিজে” মোট ৩১ টি বই আছে। প্রচুর রোম্যাঞ্চকর অভিযানে ভরপুর একেকটা বই। একটা বইতেই একটা অভিযান শেষ হয়ে যায়৷ এবং পরের বইতে শুরু হয় নতুন অভিযান। সুলতান সালাউদ্দিন আইয়্যুবি এই সিরিজের প্রধার চরিত্র এবং ক্রুসেডাররা বিপরিত চরিত্র। ক্রুসেডারদের নানান ফন্দি আর সালাউদ্দীন আইয়্যুবির বিচক্ষণতা নিয়ে এই সিরিজটি লেখা। এছাড়া এনায়েতুল্লাহ আলতামাশ খুব সম্ভবত ইতিহাস প্রেমি। এজন্যই থ্রিলিং এর হাত ধরে তিনি জানিয়ে দিয়েছে অনেক ইতিহাসও। যদি ফিকশনাল বইয়ের ইতিহাস ওতটা তথ্যবহুল নয়৷ তবুও যাদের নন ফিকশনে আগ্রহ নেই অথচ ইতিহাস জানার ইচ্ছা, তারা এই সিরিজটা পড়তে ভুলবেন না।
এই পাঁচটি সিরিজ না পড়ে থাকলেও কম বেশি অনেকেই সব সিরিজেরই নাম জানেন। বিশেষ করে যারা বই পড়ুয়া। সব গুলো সিরিজের একটা সাধারণ দিক হচ্ছে রোম্যাঞ্চের পাশাপাশি কিছু কিছু বার্তা রয়েছে পাঠকের জন্য। আর এটাই এই সিরিজ গুলোর ভালো লাগার দিক৷ যারা পড়েছেন তাদের নতুন করে কিছু বলার নেই। আর যারা পড়েন নি, তাদের বলবো এই সিরিজ গুলোর স্বাদ থেকে নিজেদের বঞ্চিত করবেন না।
This article is in Bangla. It is about some books which must be read.