২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির ১৯ তারিখ ওটিটি (ওভার দ্য টপ) প্ল্যাটফর্ম অ্যামাজন প্রাইমে মুক্তি পায় মালায়লাম ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সর্বকালের অন্যতম সেরা ক্রাইম থ্রিলার ‘দৃশ্যম’ এর সিক্যুয়েল ‘দৃশ্যম টু।’
২০১৩ তে ফিরি। মালায়লাম ইন্ডাস্ট্রিতে মোহনলাল ততদিনে ব্র্যান্ড, কিন্তু সাম্প্রতিক ফর্ম মোটেই ভালো যাচ্ছিল না। পরিচালক জিতু জোসেফ এলেন। তাকে নিয়ে বানালেন ক্রাইম থ্রিলার জনরার চলচ্চিত্র দৃশ্যম। মুক্তি পেল। এরপরের ব্যাপারখানা এমন- এলেন, দেখলেন, জয় করলেন।
২০১৩ সালের বড়োদিনকে সামনে রেখে মুক্তি পাওয়া দৃশ্যম সময়ের আবর্তে যে এত বড়ো হয়ে উঠবে তা কি জিতু কিংবা মোহনলালের কেউই ভাবতে পেরেছিলেন? না পারলেও আকাশচুম্বী সাফল্যে ভাবতে হয়েছে সিক্যুয়েলের কথা। মাঝে কেটেছে আট বছর। জিতু-মোহন জুটি আবারও ফিরে আসেন ‘দৃশ্যম ২’ নিয়ে। এবং আগের মতোই এলেন, দেখলেন, জয় করলেন।
দৃশ্যম পুরোদস্তুর থ্রিলার ঘরানার মুভি। শুরু থেকেই দর্শককে রোলার কোস্টারে চড়াবে। সেই তুলনায় দ্বিতীয় কিস্তি খানিক ধীরগতির। এতে ফ্যামিলি ড্রামাও টেনে আনা হয়েছে। অবশ্য সেটি গল্পের প্রয়োজনে। দৃশ্যমের দ্বিতীয় ছবিটি দেখার আগে দর্শককে প্রথমটি দেখতে হবে। নইলে কিছুই বোঝা যাবে না। এই চলচ্চিত্রের একটি চমৎকার দিক, সিক্যুয়েলে প্রধান চার চরিত্রের প্রত্যেকে প্রথম কিস্তির শিল্পী। একটা পিরিয়ডের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে এটি। মালায়লাম চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে, এখানে অভিনয়ের চেয়ে বাস্তবতা বেশি দেখানো হয়। অতিরঞ্জনের বালাই তেমন থাকে না। দৃশ্যম টু-তে এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। আরও একটি দিক হলো, ন্যারেশন। এত অসাধারণভাবে দুটো চলচ্চিত্রকে এক সুঁতোয় গেথেছেন জিতু, দর্শকের এত বছরের অপেক্ষা মুহূর্তে প্রশান্তিতে পরিণত হয়েছে।
“ পৃথিবীতে অসংখ্য খারাপ মানুষ থাকতে পারে। কিন্তু একটাও খারাপ বাবা নেই
হুমায়ূন আহমেদের বলা কথা দৃশ্যমে দিনের আলোর ন্যায় পরিস্কার। একজন পিতার মেয়েকে বাঁচাবার সংগ্রাম ফুটে উঠেছে সিনেমার প্রথম কিস্তিতে। দ্বিতীয় কিস্তি এগিয়েছে সাময়িকভাবে কাটিয়ে ওঠা ধাক্কা সামলে আসন্ন ঝড় মোকাবেলা করার সাহসিকতা নিয়ে। জর্জকুট্টি (মোহনলাল), সাধারণ একজন ক্যাবল ব্যবসায়ী। নিজের স্ত্রী আর দুই মেয়েকে নিয়ে ছোটো সুখের সংসার। সেখানে এক রাতের দূর্ঘটনা বেসামাল করে দেয় গোটা পরিবারকে। পুলিশের আইজি গীতা প্রভাকর (আশা শরৎ)-র ছেলে বরুণ প্রভাকর (রোশান বশির) নিখোঁজ হয়। তদন্তে বেরিয়ে আসে নিখোঁজ হওয়ার পেছনে হাত আছে জর্জকুট্টি ও তার পরিবারের। এক সময় সকলে নিশ্চিত হয় বরুণকে হত্যা করে লাশ গায়েব করা হয়েছে। কিন্তু কোথায় লাশ? কোনো হদিস পায় না পুলিশ। এরপর ছয় বছর পার হয়। দফায় দফায় তদন্ত, জিজ্ঞাসাবাদ হলেও কোনো কূল পায় না। জর্জকুট্টি এখন ক্যাবল ব্যবসায়ের পাশাপাশি সিনেমা হলের মালিক। মামলা অফিশিয়ালি বন্ধ করলেও অভ্যন্তরীণ তদন্ত জারি রাখে পুলিশ। ঘটনাচক্রে এক প্রত্যক্ষদর্শীকে পাওয়া যায়। তার বয়ানে সন্ধান মেলে লাশের।
দৃশ্যম টু-র ঠিক এখানে এসে দর্শক নড়েচড়ে বসবে। দুটো কারণ। প্রথমত, জর্জকুট্টি লাশ কোথায় রেখেছিল সেটি তারা জানতো। এবার পুলিশও জেনেছে। অর্থাৎ, প্রত্যাশার সমাপ্তি ঘটলো অবশেষে। দ্বিতীয়ত, এর পরিণতি কী হতে চললো? লাশ পাওয়ার আগ পর্যন্ত জর্জকে সন্দেহের চোখে দেখলেও কিছু করার জো ছিল না। এখন প্রমাণ পাওয়ার পর সব স্পষ্ট হয়ে যাওয়াতে সে কীভাবে বাঁচাবে নিজেকে ও পরিবারকে? সিনেমার প্রথম হাফ স্লো হলেও এতক্ষণে বুঝে গেছেন গল্পের প্রয়োজনেই ধীরেসুস্থে আসা। যেন বার্তা দিল, সামনে দুর্গম পথ। দম ফেলার সুযোগ নেই।
জর্জকুট্টি সিনেমা বানানোর স্বপ্ন দেখে। একজন প্রখ্যাত চিত্রনাট্যকারকে গল্প শুনিয়েছে। দফায় দফায় বৈঠক, মতানৈক্যের পর মোটামুটি দুইজনই সন্তুষ্ট হতে পেরেছে। সিনেমা বানানোর সময় ঘনিয়ে আসছে। তার আগে চিত্রনাট্যকে বই হিসেবে প্রকাশ করা হয় যাতে কেউ তা চুরি না করতে পারে। তবে জর্জের মাথায় যে খেলছিল অন্য কিছু যা এমনকি জানতো না তার উকিলও!
দৃশ্যমে লড়াইটা মূলত মা ও বাবার৷ একজন মা, যিনি একইসঙ্গে পুলিশের বড়ো অফিসার; একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে নিঃস্ব। ছেলের খুনিকে শাস্তি দিতে মরিয়া। খুনি কে জানার পরেও কিছু করতে না পারার শোক যাকে কুঁকড়ে খায়। অপরদিকে জর্জকুট্টি একজন সাধারণ পিতা, সাধারণ স্বামী। স্ত্রী-কন্যার অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে জড়িয়ে পড়া অপরাধ ঢাকতে প্রাণান্ত চেষ্টা করে চলেন। যিনি পরিবারের জন্য সব করতে পারেন। স্বভাবতই পুলিশ তার বিরুদ্ধে। মামুলি কারও কাছে হেরে যাওয়া মানতে তাদের কষ্ট হবার কথা। এত শত্রুদের মোকাবেলা করে কতকাল টিকতে পারবে জর্জ, প্রশ্নটি সিনেমার মূল চালিকাশক্তি।
” অপরাধ করে ঘুমাতে পারলেও অনুশোচনার হাত থেকে পালাবার কোনো পথ আজো আবিষ্কার করা হয়নি। কখনও না কখনও শেষ থেকে নতুন গল্পের শুরু হয়ে যায়। কারো চোখে ভয় তখনই দেখা দেয়, যখন অনেক দিনের জমানো আত্মবিশ্বাসে কেউ প্রচন্ড ধাক্কা মারে! “
কথাগুলোকে দৃশ্যম টু-র সারমর্ম বলা চলে। আত্মবিশ্বাসকে উপজীব্য করে পরিবারকে আগলে রাখা জর্জকুট্টিকে একসময় ভাঙ্গতে হয়। তবু তিনি মচকান না। যেকোনো পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রাখার চিরাচরিত আপ্তবাক্য মেনে পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য নিজেকে তৈরি করেন। দৃশ্যমের প্রথম ভাগ মুক্তির পর ভারতের বেশ কয়েকটি ভাষায় রিমেক হয় এটি। সবগুলো দারুণ হলেও অভিনয়ের দিক দিয়ে মোহলনালকে ছাড়িয়ে যেতে পারেননি কেউ। এমনকি তামিল রিমেক ‘পাপানাসাম’-এ অভিনয় করা কমল হাসানও নন। এর একটি কারণ হতে পারে, মোহনলাল আদতে কোনো অভিনয় করেননি। গল্পের ভেতর ঢুকেছেন, গল্পে মিশেছেন, নিজেকে বানিয়ে নিয়েছেন জর্জকুট্টি। পরের ধাপে আরও এগিয়ে। ন্যূনতম কৃত্রিমতা নেই। শান্ত চেহারায় নির্লিপ্ত চাহনি অথচ ভেতরে ভেতরে নিদারুণ ক্ষিপ্রতায় মোহনলাল বুঝিয়ে দেন কেন তাকে ‘কমপ্লিট অ্যাক্টর’ বলে ডাকা হয়!
সিনেমার চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় আলোকপাত করলে সবার আগে জ্বলজ্বল করবে জিতু জোসেফের নাম। একটা চিত্রনাট্য তৈরি করতে ছয় বছর সময় নিয়েছেন। অপেক্ষার ফল যে এত সুমিষ্ট হবে তা জিতু নিজেও ভাবতে পেরেছিলেন কি-না কে জানে! সচরাচর সিক্যুয়েল হলে আগেরটির চেয়ে পিছিয়ে থাকে।
আগে থেকে মোহনলাল ও জিতু বলে দিয়েছে, প্রত্যাশা না রাখতে। দর্শক প্রত্যাশা করেছে। মালায়লাম থ্রিলারে জিতু মানে অন্যরকম সম্ভাবনা। পৃথ্বীরাজকে নিয়ে মেমোরিস, ওঝাম কিংবা মোহনলালতনয় প্রণব মোহনলালকে নিয়ে ‘আধী’ -চলচ্চিত্রগুলোতে থ্রিলার ডিরেক্টর হিসেবে অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হন। সর্বশেষ চলচ্চিত্র ‘থাম্বী’ হতাশ করায় দর্শকের ভয় ছিল। তা পুরোপুরি কাটাতে পেরেছেন জিতু। অভিনয় নিয়ে বলতে গেলে আলোর সবটুকু লালেট্টা (মোহনলালকে ভক্তরা আদর করে লালেট্টা বলে ডাকে) কেড়ে নিলেও বাকীরা সামর্থ্য অনুসারে দারুণ করেছেন। স্ত্রী রাণী চরিত্রে মীনা, বড়ো মেয়ে আঞ্জুর ভূমিকায় আনসিবা হাসান, ছোটো মেয়ে আনুর ভূমিকায় আস্থের আনিল সাবলীল অভিনয় করেছেন। দ্বিতীয় ভাগে নতুন দুটি চরিত্র সিনেমা জমিয়ে তোলে। পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যায় পুরো সময়ে। তদন্ত অফিসার থমাস চরিত্রে মুরালি গোপি এবং সারিথা চরিত্রে অঞ্জলি নায়ার। থমাস এবং জর্জকুট্টির ব্যক্তিত্বের অঘোষিত লড়াই দর্শককে রীতিমতো জমিয়ে দেবে।
দর্শক তখনই সিনেমায় মজে যখন আবহ সংগীত, ক্যামেরার কাজ এবং এডিটিং তাকে সম্মোহিত করে। দৃশ্যম টু-র কারিগরি দিক নিয়ে আলোচনা করতে গেলে তিনজন মানুষের নাম নিতে হবে, যারা একে পারফেক্ট থ্রিলার হিসেবে উপস্থাপন করায় অনস্বীকার্য ভূমিকা রেখেছে। সতীশ কুরুপের সিনেমাটোগ্রাফি আর অনিল জনসনের মিউজিককে জায়গামতোন সেট করে এডিটর ভিএস ভিনায়ক তৈরি করেছেন মাদকতা। তাতে বুঁদ হয়ে আছে সকলে।
সবার ঊর্ধ্বে পরিবার। যা কিছু শিক্ষা, হোক ভালো অথবা খারাপ তা পরিবার থেকেই পাওয়া হয়। সন্তানকে সময় দেওয়া, কীভাবে জীবনযাপন করছে সেসব খবর রাখা প্রত্যেক বাবা মায়ের কর্তব্য। নইলে জীবনের কঠিন বাঁকে খেই হারিয়ে কালের অতলে চলে গেলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। ক্রাইম থ্রিলারের আড়ালে দৃশ্যমে গ্রামের অশিক্ষিত জর্জকুট্টি যেন এমন একটি বার্তা পৌঁছে দিল কর্পোরেট অভিভাবকদের কানে!
.
.
This Bengali movie review article on ‘Drishyam-2’. Important sources are hyperlinked inside the article.