,

টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশ দলের প্রথম জয়ের হাসি

199101 (1)

২০০০ সালে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর চার-চারটি বছর পার হয়ে গেছে। প্রথম টেস্টে নবাগত দল হয়েও ভারতের মতো দলের বিপক্ষে ৪০০ রান তোলার দুঃসাহস দেখানো বাংলাদেশ ক্রিকেট দল ততদিনে ৩৪টি টেস্ট ম্যাচ খেলেও জয়ের দেখা পায়নি কোনো ম্যাচে। এই ম্যাচগুলোতে বাংলাদেশের প্রাপ্তি বলতে ছিলো কেবল তিনটি ড্র। মুলতান টেস্টেও পাকিস্তানের বিপক্ষে জয়ের খুব কাছাকাছি গিয়েও ইনজামাম-উল-হকের এক দারুণ ইনিংসে অধরাই থেকে যায় টেস্ট জয়। এক সময় শেষ হলো অপেক্ষার পালা। ২০০৫ সালের জানুয়ারি মাসে সাদা পোশাকে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের কাছে এলো জয়োল্লাস করার সুযোগ।

চট্টগ্রামের এমএ আজিজ স্টেডিয়ামে ৬ জানুয়ারি শুরু হওয়া সেই ম্যাচে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল মাঠে নেমেছিল হাবিবুল বাশারের নেতৃত্বে। এক স্মৃতিচারণে হাবিবুল বাশার বলেন যে জয়ের উদ্দেশ্যেই সেই টেস্টে মাঠে নেমেছিলেন তারা। তাদের পরিকল্পনা ছিল নিজেদের মাটিতেই শূন্য টেস্ট জয়ের রেকর্ডটির ইতি ঘটাবেন তারা। ম্যাচটা ছিল বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর। যেই দলই টেস্টটি হারতো, তাদের টেস্ট স্ট্যাটাস নিয়ে প্রশ্ন উঠত তখন। তাই জয়টা একটু বেশিই দরকার ছিলো বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের।

এক স্মৃতিচারণে হাবিবুল বলেন,”২০০৫ সালে আমরা যখন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে খেলেছিলাম, আমরা বুঝতে পারছিলাম যে আমাদের জেতার সুযোগটা আছে। আমরা সেভাবে প্রস্তুত হচ্ছিলাম। নিজেদের মধ্যে বলছিলাম যে আমরা যদি একসাথে লেগে থাকি, তাহলে আমাদের জেতার সুযোগ আছে। যত যা-ই হোক আমরা হারবো না। এই টেস্ট যেভাবেই হোক আমাদের জিততে হবে। আমাদের উপর চাপ ছিল যে দেশের হয়ে টেস্টে জয় আনতেই হবে।“

বাংলাদেশ দলের প্রথম টেস্ট ম্যাচজয়ের অধিনায়ক হাবিবুল বাশার সুমন Image Source: cricinfo.com

টসে জিতে প্রথমে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নিলেন হাবিবুল বাশার। আগের ম্যাচের অভিজ্ঞতা থেকেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন টাইগার অধিনায়ক। বড় রানের টার্গেট দিয়ে প্রতিপক্ষকে চাপে ফেলাটাই ছিল হাবিবুলের প্রাথমিক লক্ষ্য।

“আমরা টসে জিতে প্রথমে ব্যাটিং নিলাম কারণ আমরা জানতাম আমাদের জেতার ভালো সুযোগ রয়েছে।“ নিজেদের দুর্বল দিকটা যে নিজেদের শক্তি দিয়ে জয় করতে  চাচ্ছিলেন সেটাও বোঝা গেছে সাবেক অধিনায়কের কথায়। “বাংলাদেশ দলের জন্য চতুর্থ দিনে ব্যাটিং করাটা কঠিনই বলা যায়।“

Jabed umar and nafis iqbal
উদ্বোধনী জুটি হিসেবে নেমে ৯১ রান করেন জাভেদ ওমর(বামে) এবং নাফিস ইকবাল(ডানে); Image Source: www.gettyimages.com

অধিনায়ককে হতাশ করেননি ওপেনিং জুটিতে নামা জাভেদ ওমর বেলিম এবং নাফিস ইকবাল। তাদের উদ্বোধনী জুটিতে ৯১ রান যুক্ত হয় দলের রানের খাতায়। প্রথম ইনিংস শেষে বাংলাদেশ দলের সংগ্রহ ছিলো ১৪৯ ওভারে ৪৮৮ রান। কিন্তু অবাক করার মতো ব্যাপার হলো দলের কেউই শতকের দেখা পাননি সেই ম্যাচে। ছিল কয়েকটা অর্ধশতক। তিনে নেমে অধিনায়ক হাবিবুল বাশার করেন দলীয় সর্বোচ্চ ৯১ রান। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান করেছিলেন রাজিন সালেহ। তার ব্যাট থেকে এসেছিল ৮৯ রান। বাকি সবার রানই অর্ধশতকের আশেপাশে ছিল। মাশরাফি এবং খালেদ মাসুদ কেবল সামান্যের জন্য আটকে গিয়েছিলেন অর্ধশতক ছুঁতে গিয়ে।

ব্যাটিংয়ে অর্ধশতক না ছোঁয়ার আক্ষেপটা ছিলো মনে হয় পেসার মাশরাফি বিন মর্তুজার মনে। প্রথম ইনিংসে ব্যাটিং করতে নামা জিম্বাবুয়ের খুঁটি দুর্বল হয়ে পড়ে তরুণ এই পেসারের পেস আক্রমণে। তার এবং তাপস বৈশ্যর পেস আক্রমণ, সাথে স্পিনার মোহাম্মদ রফিকের বামহাতের ঘূর্ণিতে খুব দ্রুতই দিশে হারিয়ে ফেলে জিম্বাবুয়ের ব্যাটিং লাইনআপ। রানের খাতায় ১৫২ উঠতে না উঠতেই ৬ উইকেট হারিয়ে ফেলে তারা। জিম্বাবুয়ে দল তখন ফলো-অনের আশঙ্কায়। কিন্তু জিম্বাবুয়ে অধিনায়ক তাতেন্দা তাইবুর ব্যাটে সওয়ার হয়ে ৩১২ রানে গিয়ে তাদের প্রথম ইনিংস শেষ হয়। ইনিংস শেষে মাশরাফির সংগ্রহ ছিল তিন উইকেট, মোহাম্মদ রফিকের শিকার ছিলো পাঁচ।

Mshrafee mash
তাপস বৈশ্য এবং মাশরাফির বোলিং তোপে জিম্বাবুয়ের ব্যাটিং লাইনআপ ছিল বিধ্বস্ত Image Source: ICC Official Facebook Page

প্রথম ইনিংস যতটা ভালোভাবে শুরু হয়েছিল, দ্বিতীয় ইনিংসের শুরুটা ছিল ঠিক ততটাই খারাপ। দলের সংগ্রহ যখন মাত্র ৭, তখনই আউট হয়ে যান ওপেনার নাফিস ইকবাল। আবারও ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হন হাবিবুল বাশার। দলের অধিনায়ক আবারও ধরেন ম্যাচের হাল। সবার ভরসার প্রতিদান দিয়ে হাবিবুল বাশার করেন ৫৫ রান। প্রথম ইনিংসে নিজের ৯৪ এর চেয়ে দ্বিতীয় ইনিংসের এই ৫৫ রানকেই এগিয়ে রেখেছেন হাবিবুল বাশার সুমন। কেননা দলের জয়ের জন্য, দলের খেলোয়াড়দের মনোবল ধরে রাখার জন্য এই ইনিংসটা বেশি জরুরি ছিল। প্রথম ইনিংসে পায়ে ব্যাথা পেয়েছিলেন সেই ইনিংসের ওপেনার জাভেদ ওমর। মাঠে তার নামাটা শঙ্কাময়ই ছিল। তবে মনের জোরের কাছে হার মেনেছে তার শরীরের ব্যাথা। সাত নম্বরে নেমেছিলেন ব্যাটিং করতে। ৩.৯৮ গড়ে রান সংগ্রহ করতে থাকা বাংলাদেশ দল ইনিংস ঘোষণা করে যখন ৯ উইকেটে বাংলাদেশ দলের সংগ্রহ ২০৪ রান।

mash
দলের হয়ে প্রথম ম্যাচে ৯৪ এবং স্বিতীয় ম্যাচে ৫৫ রান করেন বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক হাবিবুল বাশার সুমন; Image Source: www.cricketcountry.com

জয়ের জন্য তখন জিম্বাবুয়ের দরকার ছিল ৩৮১ রান। মাশরাফির যেমন অর্ধশতক না ছোঁয়ার ক্ষোভ ছিল, এনামুল হক জুনিয়রের হয়ত ছিল ব্যাটিং না করতে পারার ক্ষোভ। সেই ঝাল মেটান তিনি জিম্বাবুয়ে ব্যাটসম্যানদের উপর। তাপস বৈশ্য-মাশরাফি বিন মুর্তজাদের সাথে এবার জ্বলে উঠেছিলেন ১৮ বছর বয়সী এনামুল হক জুনিয়র। তাপস বৈশ্যর তোপের আঘাতে মাত্র ৩.৪ ওভারেই জিম্বাবুয়ে দলের স্কোর ছিল ২ রানে ২ উইকেট। ম্যাচের চতুর্থ দিনে তাপসের এই শুরুটা বাংলাদেশ দলের জন্য খুবই জরুরি ছিলো।

পঞ্চম দিনে বল হাতে আবির্ভূত হলেন এনামুল হক জুনিয়র। সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেদিন মঞ্চের আলো সবটুকু নিজের দিকে নিয়ে আসেন এনামুল। প্রথম ইনিংসে কোনো উইকেট না পেলেও শেষদিন ৪৫ রান দিয়ে তুলে নেন ছয়টি উইকেট। হামিল্টন মাসাকাদজা(৫৬) এবং ব্রেন্ডন টেইলর(৪৪) ছাড়া রানের ঘরে দুই অঙ্ক ছুঁতে পেরেছিলেন ওপেনার স্টুয়ার্ট মাতসিকেনইয়েরি। এই তিনজনই পরে শিকার হন এনামুলের স্পিনবিষের। হামিল্টন মাসাকাদজা করেছিলেন ১০ রান। তাকে বধ করেন পেসার মাশরাফি বিন মর্তুজা। তিনি এবং তাপস বৈশ্য দুইজনই পেয়েছিলেন দুটি করে উইকেট। বাংলাদেশের বোলিংয়ের কাছে, বিশেষ করে এনামুল হক জুনিয়রের কাছে হার মেনে যায় জিম্বাবুয়ে দল।

অবশেষে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ক্রিজে তখন ডগলাস হন্ডো এবং ক্রিস্টোফার এমপোফু। স্ট্রাইক প্রান্তে এমপোফুই ছিলেন। এনামুলের বলে জিম্বাবুয়ের ক্রিস্টোফার এমপোফু তালুবন্দী হন সিলি পয়েন্টে আশরাফুলের হাতে। বল হাতে নিয়েই মোহাম্মদ আশরাফুল দিলেন ভোঁ-দৌড়। উন্মাদের মতো চিৎকারে ফেটে পড়ল চট্টগ্রাম এম এ আজিজ স্টেডিয়াম। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো টেস্টে জয়ের হাসি হাসে বাংলাদেশ। টানা ১৬টি সিরিজে হারের মুখ দেখতে দেখতে ক্লান্ত বাংলাদেশ দল অবশেষে পেল জয়ের দেখা। ১০ জানুয়ারি তারিখটা তখন এক আনন্দের উপলক্ষ ক্রিকেটপ্রেমী বাঙালির কাছে।

কেমন ছিলো সেই দিনটা? কেমন ছিলো জয়ের অনুভূতি? অধিনায়কের মুখ থেকেই শোনা যাক।

“আমার জীবনের সেরা দিন এটা,” হাবিবুল বাশার ম্যাচের পর বলেন,”দেশের হয়ে প্রথম টেস্ট জেতা দলের সদস্য এটা কখনোই ভুলার নয়।“

দুই ইনিংসে দলের হয়ে সর্বোচ্চ রান করলেও তার কৃতিত্ব নিচে চাননি  সাবেক এই অধিনায়ক। “এই দলটার সদস্য হতে পেরেই আমি খুশি,” বলে যান এই ব্যাটসম্যান,”সেই মুহূর্তে আর কোনো কিছুই গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে না, এমনকি আমি যে অধিনায়ক  এটাও না। ম্যাচ যখন শেষ হলো আমি বুঝতে পারছিলাম না কি করবো। পরের তিন-চার মিনিট কি হয়েছে আমার কিছুই মনে নেই।“

bd cricket
জয়ের দেখা মিলল অবশষে Image Source: ICC Official Facebook Page

সেই জয়ের কেটে গেছে ১৬টি বছর। রঙিন জার্সি গায়ে পারফর্মেন্স ভালো হলেও সাদা জার্সি গায়ে আজও ম্লান বাংলাদেশ দল। টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশ দলের রেকর্ড খুব একটা ভালো নয়। ওয়ানডেতে যেমন বাংলাদেশের পারফর্মেন্স যেমন আশাজাগানিয়া, টেস্টে ঠিক ততটাই হতাশাজনক। ওয়ানডেতেও যেমন বাংলাদেশ ধীরে ধীরে উন্নতি করছে, এই আশা করাই যায় একদিন টেস্ট ক্রিকেটেও শক্ত প্রতিপক্ষ হিসেবে উঠে দাঁড়াবে বাংলাদেশ দল।

——————————————————————————————————————–References:

ফিচার ইমেজ: Cricketsoccer.com

Related Articles

অন্যান্য
Sirajul Islam Mozumder

পিকি ব্লাইন্ডার্সঃ বিংশ শতাব্দীতে বার্মিংহামের রাস্তা দাপিয়ে বেড়ানো এক দস্যুদল

“বাই দি অর্ডার অব পিকি ব্লাইন্ডার্স”। আপনি যদি সিরিজপ্রেমী হয়ে থাকেন, তবে এই বাক্যটির সাথে

বিস্তারিত »
সোশ্যাল মিডিয়া
পাঠক প্রিয়
খেলা
ফেইসবুক পেজ