, ,

সমাধি রীতিঃ ধর্ম-জাতি ভেদে ভিন্নতা কতখানি?

cemetery-graveyard-grave-tomb

দীর্ঘ প্রতীক্ষা আর শত অসুস্থতা, বাধা পেরিয়ে পৃথিবীতে আসি আমরা। সাধারণত সেই আগমন ঘিরে হয় কত আনন্দ, কত কত উল্লাস। কোথাও কোথাও রীতিমতো ঢাক-ঢোল পিটানো হৈ-হুল্লোড় আর উৎসব।

কিন্তু মৃত্যু? ওটা নীরবে হঠাৎ করে আসে। কাঁদায়, যন্ত্রণা দেয়। শূণ্যতা তৈরি করে পুরো অস্তিত্ব জুড়ে। তাই তো এই উপলক্ষে কোন উৎসব নেই আমাদের। নেই হৈ-চৈ করে  উদযাপন। স্রেফ নীরবে বিদায়। সঙ্গী তখন স্বজনদের আহাজারি। প্রিয় মানুষদের বুকভাঙা আর্তনাদ। ঠিকানা শ্মশান। কিংবা নাম ফলকের শীতল বাগান, অথবা গভীর কবর।

অবশ্য ব্যতিক্রম আছে এখানেও। আছে জাতি-ধর্মভেদে অনেক ভিন্নতা। কিংবা হা হয়ে শোনার বা দেখার মতো ঘটনা। তেমনই বিশ্বজুড়ে সমাধিস্থ করার কিছু একেবারে ভিন্ন রীতি বা অনুষ্ঠানের কথা বলবো আজ।

১. দক্ষিণ কোরিয়ার পুঁতি-রীতি

পুরো বিশ্বজুড়ে থাকা অসংখ্য সমাধি রীতি বা নিয়মের একটা হলো দাহ পদ্ধতি। যার মানে হলো শ্মশান বা অন্য কোথাও (বৈদ্যুতিক চুল্লী বা অন্য কোন চুল্লী) গিয়ে শব পোড়ানো। কিন্তু এই রীতিটাকেই রীতিমতো আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ানরা।

মৃতদেহ পোড়ানো ছাইকে তারা চাপ দিয়ে সংকুচিত করে পরিণত করে জপমালার গুটি বা পুঁতিতে। রঙবেরঙের হয় সেই পুঁতিগুলো। গোলাপি, কালো, সবুজ, ফিরোজা। তারপর কাচের জারে ঢুকিয়ে রাখে সেগুলো। বা রেখে দেয় খোলা পাত্রে। তারপর বাড়ির পছন্দমতো কোন জায়গায় সাজিয়ে রাখা।

দক্ষিণ কোরিয়ানরা মৃতদেহ পোড়ানো ছাই দিয়ে তৈরি করে রঙবেরঙের পুঁতি image source: Deseret News

২. ফিলিপিনো বহু-রীতি

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি দেশ ফিলিপাইন। কিন্তু দেশ একটি বলে কি তাদের নিয়মনীতিও একটাই হবে নাকি?

না, বরং ফিলিপাইনের টিংগুয়াইন উপজাতির লোকজন কেউ মারা গেলে সেই মৃতদেহকে তার (মৃতের) সবচাইতে সুন্দর পোশাকটি পরিয়ে একটা চেয়ারে বসিয়ে রাখে। ঠোঁটে ধরিয়ে দেয় জ্বলন্ত সিগারেট। তারপর সেই চেয়ারকে (বসে থাকা মৃত মানুষটাসহ) এনে রাখে বাড়ির প্রবেশপথে।

বেঙ্গুয়েট উপজাতির লোকেরা একটু লাজুক। তাই বোধহয় মৃতদেহের চেয়ারটা এনে ঘরের দুয়ারে রাখার আগে মৃতের চোখ দুটো বেঁধে দেয় তারা।

সেবুয়ানো উপজাতি সমাধি অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার পূর্বে তাদের বাচ্চাকাচ্চাদের লাল জামাকাপড় পরিয়ে দেয়৷ যাতে ভূত দেখার আশঙ্কা কমে যায় তাদের। পেছনের যুক্তিটা ভাবছি। ভূতের কি তবে লাল রং অনেক অপছন্দ?

সাগাদা প্রদেশে মৃতের কফিনকে উঁচু ও খাড়া পাহাড়ের গা থেকে ঝুলিয়ে দেয়া হয়। আশা করা হয়, এতে মৃত মানুষটার বিদেহী আত্মা নিকটবর্তী হয় স্বর্গের।

সাগাদার ঝুলন্ত কফিন রীতি image source: Ancient Pages

কাভিটে’র লোকজন ফাঁপা গাছের ভেতর মৃতদেহকে খাড়াভাবে সমাহিত করে। আর সেই গাছ বেছে নেয়ার সম্মানটি কার হয় জানেন? মৃতব্যক্তির নিজের। মৃত্যুর আগে নিজেকে সমাহিত করার জন্য একটা গাছ সে পছন্দ করে যেতে পারে!

৩. ব্রাজিল ও পাপুয়া নিউগিনির মৃত ভক্ষণ-রীতি

পুরোনো দিনগুলোতে পাপুয়া নিউগিনির ম্যালেনিশিয়ানগণ এবং ব্রাজিলের ওয়ারি লোকজন মৃতদের কেটেকুটে খেয়ে ফেলতো। তাদের বিশ্বাস ছিলো, এই রীতির মাধ্যমে মৃত্যুকে ঘিরে থাকা সব ভয় ও রহস্য সহজ হবে তাদের জন্য। কেটে যাবে মৃত্যু নামক প্রাচীন নিয়মের সব শংকা, আতঙ্ক।

ইয়ানোমামি লোকজনের মাঝেও এই প্রথা প্রচলিত ছিলো।

মৃত ভক্ষণ রীতি image source: Wikicommons

৪. ফামাদিহানার মৃতের সাথে নৃত্য-রীতি

ফামাদিহানার মাদাগাস্কারের অধিবাসি মালাগাসি লোকজন বেশ রসিক বলা যায়। তারা তাদের প্রিয়জনদের সমাহিত মৃতদেহ প্রতি পাঁচ বা সাত বছরে একবার কবর খুঁড়ে তুলে আনে। তারপর সেই তুলে আনা হাড়গোড় বা অবশিষ্টাংশকে নতুন কাপড়ে পেঁচিয়ে সে কাপড়ের বস্তা নিয়ে সবাই মিলে নাচতে থাকে। সাথে বাজতে থাকে উঁচু স্বরের গানবাজনা।

তাদের এই রীতির নামকে অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, ‘হাড়ের ঘূর্ণন বা কুর্দন’। আর এর উদ্দেশ্য মৃত লোকটার দেহকে তাড়াতাড়ি পচিয়ে ফেলে তার আত্মাকে দ্রুত পরকালে পাঠিয়ে দেয়া।

যুক্তিটা ফেলে দেয়ার মতো নয়, কী বলেন?

ফামাদিহানার মৃতের সাথে নৃত্য-রীতি image source: flikr

৫. চীনের স্যুট-আপ ও ঝুলন্ত রীতি

একটু আগেই বলেছিলাম, ফিলিপাইনের সাগাদা অঞ্চলের লোকেরা খাড়া পাহাড়ের গায়ে মৃতের কফিন ঝুলিয়ে রাখে। যাতে বিদেহী আত্মা স্বর্গের কাছাকাছি হতে পারে। একই রীতি প্রচলিত আছে চীনেও।

হান সাম্রাজ্যের শাসনামলে রাজকীয় সদস্যদের কারো মৃত্যু হলে তাদের জন্য তাদেরই মাপে প্রস্তুত করা হতো জেড পাথরের পোশাক। জেড পাথরকে ছোট ছোট চারকোণা বা ত্রিভুজ আকৃতির করে কেটে তার দিয়ে জুড়ে দিয়ে তৈরি করা হতো সেই বিশেষ পোশাক। অনেকটা বর্ম পোশাকের মতো ছিলো সেটা, যা দিয়ে মৃতের পুরো শরীর আগাগোড়া ঢেকে দেয়া যেতো।

আর ও হ্যাঁ, পোশাকগুলো ছিলো অনেক দামী এবং প্রস্তুত করতে লেগে যেতো কয়েক বছর।

জেড পাথরের পোশাক image source: Ever plans

৬. তিব্বতের আকাশ সমাধি-রীতি

বৌদ্ধ ধর্মের অনেক মতবাদ বা নিয়ম অনুযায়ী, মৃতদেহ দাহ করতে বা পুড়িয়ে ফেলতে হয়। কিংবা দান করে দিতে হয় পশুদের খাবার হিসেবে। এতে দানশীলতা ও সহানুভূতির পরিচয় পাওয়া যায়।

প্রথমত শবদেহকে কেটে টুকরো টুকরো করে একটা পাহাড়ের উপর ছড়িয়ে দেয়া হয়। যাতে শকুন বা অন্যান্য মাংসাশী পাখি তা খেতে পারে। খাওয়া শেষে ওরা চলে যাওয়ার পর পড়ে থাকা হাড়গুলো কুড়িয়ে এনে সংগ্রহ করা হয়। পরবর্তীতে সেই হাড় গুঁড়ো করে খাওয়ানো হয় কাকদের।

তিব্বতের আকাশ উৎসর্গ বা সমাধি রীতি image source: Wikicommons

একইভাবে মঙ্গোলিয়ান’রা পালন করে আকাশ উৎসর্গ রীতি। এই রীতি অনুযায়ী মৃতের পরিবার তার দেহকে খোলা আকাশের নিচে শুইয়ে দেয় এবং শুইয়ে রাখা দেহের সীমারেখা এঁকে দেয় পাথর সাজিয়ে। তারপর ক্ষুধার্ত কুকুর ও পাখিদের সুযোগ করে দেয় সেই মৃতদেহ থেকে ভোজন পূর্তি করার। একটা সময় পেছনে পড়ে থাকে শুধু পাথর সাজানো সীমারেখাটি। আত্মার বহিঃপ্রকাশ বলে তারা একে।

৭. প্রাচীন মিশরের আজব, বিশেষ রীতি

প্রাচীন মিশর। অদ্ভুত আর চমকপ্রদ সব দেবদেবীর দেশ। প্রতাপশালী সম্রাট, তাদের পরমা সুন্দরী সম্রাজ্ঞী, কুচক্রী যুবরাজ, সুদর্শন রাজপুত্র, চঞ্চলা রাজকন্যার দেশ। আছে রাজপ্রাসাদের জটিল সব রাজনীতি, বিভিন্ন সব ধর্মের ইতিহাস আর আচার অর্চনার নজিরও।

তাহলে এমন একটা দেশের সমাধি রীতিনীতি খুব আগ্রহ উদ্দিপক হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই, তাই না?

আমি, আপনি মোটামুটি সবাই-ই মিশরীয়দের মমি প্রথা সম্পর্কে কমবেশি জানি। শুনেছি, দেখেছি। তবু একটু মনে করিয়ে দিচ্ছি এখন।

এই মমিকরণ প্রথা অনুযায়ী, রাজপরিবারের কোন সদস্য বা বিশিষ্ট কোন ব্যক্তি মারা গেলে যত্ন করে তাকে গোসল করিয়ে তার শরীরের সব পচনশীল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বের করে নেয়া হতো। তারপর ফাঁপা শরীরের ভেতর পোরা হতো বিশেষভাবে প্রস্তুতকৃত সুগন্ধি মসলার মিশ্রণ। তারপর আরকে ভেজানো মূল্যবান লিনেন কাপড়ে পেঁচিয়ে একাধিক কফিন। মৃতের চেহারার আদলে বানানো মুখ বিশিষ্ট কফিনের নাম সারকোফাগাস।

মিশরীয় সারকোফাগাস image source: voice of America

তো যা বলছিলাম, একাধিক কফিনে মমিকৃত শবদেহটি রাখার পরে বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান পালন শেষে এর স্থান হয় পিরামিড বা অন্য কোন সমাধিস্থলে।

ফুউ! অনেক কাজ, তাই না? কিন্তু এখানেই শেষ নয়। আরও রীতি আছে এর মাঝে।

পিরামিডের ভেতরে মৃতব্যক্তির সাথে দেয়া হতো মূল্যবান সব রত্ন, আসবাবপত্র, পোশাক-আশাক, খাবারদাবার। এমনকি মৃত মানুষটা খুব অভিজাত কেউ হলে তার সঙ্গে দেয়া হতো কয়েকজন দাসদাসীও। পরবর্তী জীবনের আরাম আয়েশের জন্য দাসদাসীর প্রয়োজন পড়বে না?

তবে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, প্রাচীন মিশরীয়গণ পুরো সমাধিস্থল জুড়ে বিভিন্ন সাংকেতিক চিহ্ন ও চিত্রলিপির মাধ্যমে বর্ণনা করে যেতো মৃতব্যক্তির জীবনের ছোট-বড় ঘটনা। সাথে বারবার উল্লেখ করে দিতো তার নাম। কেননা তারা বিশ্বাস করতো, নামহীন ব্যক্তির কাছে প্রার্থনা পৌঁছায় না। সে পায় না পরলোক গমনে শিয়ালমুখো দেবতা আনুবিসের কোন সাহায্যও।

আর তাই নাম, পরবর্তী জীবনের জন্য দিকনির্দেশনা, মন্ত্রতন্ত্র -এসব খুব প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ ছিলো তাদের জন্য। তাইতো এই তথ্যগুলো সব একত্রিত করে প্যাপিরাসে লিখে মৃতের সমাধিতে রেখে দিতো তার আত্মীয় স্বজন। কখনও সখনও লিখে দিতো শব জড়ানো লিনেনের উপরেই।

বুক অফ দ্য ডেড image source: Brewminate

‘বুক অফ দ্য ডেড’ খ্যাত এই পান্ডুলিপি ছিলো প্রাচীন মিশরের সমাহিত রীতির এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আপনি একে পরলোকের গাইডও বলতে পারেন।

আর সবশেষে বলতে পারেন, আসলেই ভিন্ন সব রীতিনীতির এক জগৎ আমাদের।

Featured Image: Wallpaper Flare

References:

  1. 7 Unique Burial Rituals Across the World
  2. Funeral & Burial Rituals From Around The World
  3. 15 Of The Strangest Funeral Customs From Around The World
  4. Death is not the end: Fascinating funeral traditions from around the globe
  5. Funerals in ancient Egypt
  6. Ancient Egyptian Burial
  7. The Book of the Dead was Egyptians’ inside guide to the underworld

Related Articles

অন্যান্য
Sirajul Islam Mozumder

পিকি ব্লাইন্ডার্সঃ বিংশ শতাব্দীতে বার্মিংহামের রাস্তা দাপিয়ে বেড়ানো এক দস্যুদল

“বাই দি অর্ডার অব পিকি ব্লাইন্ডার্স”। আপনি যদি সিরিজপ্রেমী হয়ে থাকেন, তবে এই বাক্যটির সাথে

বিস্তারিত »
সোশ্যাল মিডিয়া
পাঠক প্রিয়
খেলা
ফেইসবুক পেজ