গল্পে ভরা এই জীবনে আমাদের যেন গল্পের শেষ নেই। প্রতিনিয়ত সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন গল্প। এক সমুদ্র অনুভূতি কিংবা এক পৃথিবী ভালোবাসা নিয়েই এরকম একটি গল্প লিখতে বসে গেলাম। এক পৃথিবী লিখবো বলে একটা খাতাও শেষ করিনি,কিন্তু একটি গল্প তো বলে শেষ করাই যায়। পাঠকদের আজ গল্প শোনাবো বলে কিবোর্ডে চোখ বুলোতে বড্ড ইচ্ছে হচ্ছে। একদম জীবন থেকে নেয়া গল্প কিংবা সচেতনতা কিংবা বৃক্ক পাথরের নাড়ি নক্ষত্র।
বইয়ে কিংবা জীবনের মোড়ে মোড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানা গল্প;
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ Nong Vang, unplash.com
গল্পের এই সাম্রাজ্যে আমরা হরহামেশাই খুঁজে বেড়াই নিজেকে। অবচেতন মনে হয়তো প্রায়ই বলে উঠি, “ আরেহ, এ যে আমার জীবনেরই গল্প!”। প্রাচীন গ্রিসের অনেক গল্পই আমরা শুনেছি বা জেনেছি ছোটবেলার একটা বিরাট অংশজুড়ে; কখনো বইয়ের পাতায়, কখনো আবার লোকমুখে। এই যেমন কসের হিপোক্রেটিস (গ্রিক: Ἱπποκράτης; Ἱπποκράτης ইপ্পোক্রাতেস্); /hɪˈpɒkrəˌtiːz/) (৪৬০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ – ৩৭৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)- এর কথাই ধরুন না! পেরিক্লেসের যুগের এই বিশিষ্ট চিকিৎসাবিজ্ঞানীকে ‘পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক’ হিসেবে অনেকে অভিহিত করেন। অনেকে আবার তাঁকে চিনেন দ্বিতীয় হিপোক্রেটিস নামে। তখনকার একটি গল্পের চিত্রায়ণ থেকেই পাঠকদের নিয়ে একটুখানি ঘুরে আসি এবার, ঘুরে আসি বৃক্ক পাথর আবিষ্কারের আদিম যুগে।
ধারণা করা হয়, ৪০০০ খিস্টপূর্বাব্দ থেকে মানুষ বৃক্কপাথর রোগে আক্রান্ত হয়ে আসছে। কথিত আছে, প্রাচীন এক মিশরীয় মমির শরীরে সর্বপ্রথম এই বৃক্কপাথরের অস্তিত্ব পাওয়া যায়।
বৃক্কপাথর কিংবা কিডনিতে পাথর; ইংরেজিতে যাকে বলে Kidney Stone। বিজ্ঞানের পরিভাষায় এটিকে অভিহিত করা হয় Renal Calculi, Nephrolithiasis অথবা Urolithiasis হিসেবে। সে যাই ই হোক, বৃক্কপাথর আবিষ্কারের কৃতিত্ব প্রদান করা হয়েছে প্রাচীন গ্রিসের ‘দ্বিতীয় হিপোক্রেটিস’কে যিনি ‘হিপোক্রেটিস অব কস’ নামে বিখ্যাত হয়ে আছেন ইতিহাসের পাতায়। সেদিন কে জানতো, হিপোক্রেটিসের আবিষ্কৃত এই পাথরই হয়তো প্রবেশ করে বসে থাকবে একবিংশ শতাব্দীর মানুষের জীবনের গল্পেও! Oath of Medical Ethics for physicians বা চিকিৎসাশাস্ত্রের বেদবাক্য বলে খ্যাত ‘Hippocratic Oath’ এ- বৃক্ক পাথর সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন,
“I will not cut for the stone, but will leave this to be done by practitioners of this work.”
হিপোক্রেটিস; ছবি কৃতজ্ঞতাঃ ancientpages.com
মানব শরীরে বৃক্কপাথর আবিষ্কারের পর কেটে গেছে বেশ লম্বা একটা সময়। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন চিকিৎসকের মাধ্যমে আধুনিকায়ন এসেছে এই রোগের চিকিৎসাপদ্ধতিতেও। গল্পের এই পর্যায়ে এসে কোন পাঠক যদি ভ্রু কুঁচকে আমাকে জিজ্ঞেস করে বসেন, “ সব ই তো বুঝলাম মশাই, কিন্তু বৃক্কপাথরের সংজ্ঞাই তো এখনো দিলেন না !”। চমকে গিয়ে এই আমিই হয়তো তখন জিহ্বাতে কামড় দিয়ে বলে বসবো, “hard deposits made of minerals and salts that form inside your kidneys”। বাংলা অনুবাদে যার অর্থ হয়, “কিডনি বা বৃক্কের অভ্যন্তরে খনিজ এবং লবণের মিশ্রণে গঠিত কঠিন পদার্থ”।
গল্পের ভিতর গল্প কিংবা বৃক্কের ভিতর পাথর, সে যাই হোক এবার তাহলে চিকিৎসাশাস্ত্রে একটু খানি চোখ বুলানো যাক।
বৃক্কের নাড়ি নক্ষত্র, ছবি কৃতজ্ঞতাঃ surgeryjournal.co.uk
বৃক্কপাথর রোগের উপসর্গ অনেকটাই নির্ভর করে পাথরের ধরন,আকার-আকৃতি কিংবা অবস্থানের উপর। আবার পাথর যদি খুবই ছোট হয়, সেক্ষেত্রে কোন রকম উপসর্গ ছাড়াই তা মানব শরীরে দীর্ঘদিন অবস্থান করতে পারে। শুরুতে বলেছিলাম না! গল্পের সাম্রাজ্যে নিজেদের খুঁজে বেড়ানো আমরা অবচেতন মনে অনেক সময়ই বলে উঠি, “ আরেহ, এ যে আমার জীবনেরই গল্প!”। কিন্তু এই বৃক্ক পাথর কীভাবে আমাদের জীবনের গল্পে উঠে এলো ? পাঠক, আপনি জানেন কি ! “পৃথিবীতে প্রতি দশজন মানুষের মধ্যে অন্তত একজন জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে বৃক্কে পাথর জনিত সমস্যায় ভোগেন।” ছোটবেলায় শোনা “কান টানলে মাথা আসে” প্রবাদটা এবার বোধ হয় আমাদের ভাবিয়েই ছাড়বে। ভাবনার জগতে আরেকটু ডুব দেয়া যাক।
মানব শরীরে বৃক্কের অবস্থান, ছবি কৃতজ্ঞতাঃ uhhospitals.org
মলমূত্র ত্যাগ প্রায় প্রতিটি প্রাণীরই নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হলেও এই সাধারণ কাজটিই মানুষের জন্য অসাধারণ বিড়ম্বনা হয়ে দাঁড়াতে পারে বৃক্কে পাথর গঠিত হলে। বৃক্ক আমাদের শরীরের যাবতীয় আবর্জনা ছেঁকে শরীর থেকে বের করে দেবার প্রাণপণ চেষ্টা করে যায় প্রতিনিয়ত। আর রাসায়নিক উপাদানে তৈরি পাথর ক্ষেত্রবিশেষে বাধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায়। ফলাফলস্বরূপ, অনেক বিষাক্ত পদার্থ ও আবর্জনা মানব শরীর থেকে যথাযথভাবে বের হতে পারে না এবং মানবশরীরের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলে। কোমর, তলপেট কিংবা উরুর আশেপাশে কমবেশি ব্যথা ছাড়াও মূত্রক্রিয়াতে অস্বস্তিসহ মূত্রের সাথে বের হতে পারে রক্তও।বমি-বমি ভাব কিংবা বমি হওয়াও এই রোগের আরেকটি লক্ষণ। এছাড়াও এই রোগের প্রতিক্রিয়া শরীরে ডিহাইড্রেশন বাড়িয়ে দিতে পারে। যথাযথ চিকিৎসার অভাবে কিডনি ফেইলার বা বৃক্ক বিকল হতে পারে, হতে পারে মৃত্যু পর্যন্ত। আর এই বৃক্কপাথর জনিত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। প্রথম নেপোলিয়ন (সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট, ১৫ই আগস্ট ১৭৬৯ – ৫ই মে, ১৮২১), তৃতীয় নেপোলিয়ন(প্রথম নেপোলিয়নের ভাতিজা ফরাসী রাষ্ট্রপ্রধান চার্লস লুই নেপোলিয়ন বোনাপার্ট, ২০শে এপ্রিল, ১৮০৮ – ৯ই জানুয়ারি, ১৮৭৩), স্যার আইজ্যাক নিউটন(৪ঠা জানুয়ারি, ১৬৪৩ – ৩১শে মার্চ, ১৭২৭) সহ অনেকেই এই রোগের রোগী হয়েছিলেন জীবনের একটি পর্যায়ে। প্রতি বছর অর্ধ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ হাসপাতালে জরুরী বিভাগের শরণাপন্ন হয় এই রোগের কারণে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৭০ সাল থেকে ২০০০ সালের মধ্যে এই রোগ শতকরা হার ৩.৮% থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮.৮%। ২০১৩-১৪ সালে তা গিয়ে কড়া নেড়েছে ১০% লোকের দরজায়। বৃক্কপাথর রোগের সম্ভাবনা ছেলেদের মাঝে ১১% এবং মেয়েদের মাঝে ৯%। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং স্থূলতা এই রোগের সম্ভাবনা আরও বাড়িয়ে দেয়। তবে ভয়ের কিছু নেই, যথাযথ সচেতনতা পারে এই রোগটি থেকে আমাদের সবাইকে নিরাপদ রাখতে।
বৃক্কে পাথর, ছবি কৃতজ্ঞতাঃ gleneagles.com.sg
ক্যালসিয়াম, ইউরিক এসিড, স্ট্রুভিট এবং সিস্টিনসহ নানা ধরনের প্রভাবে পাথর গঠিত হয় বৃক্কে। তবে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কিডনি পাথরের জন্য দায়ী ক্যালসিয়াম অক্সালেট।
পানি কম খাওয়াকেই বৃক্কে পাথর গঠিত হবার মূল কারণ হিসেবে অনেকে চিহ্নিত করে থাকেন। মাত্রাতিরিক্ত ক্যালসিয়াম অক্সালেটযুক্ত খাবার গ্রহণকেওএই কার্যকারণের প্রথম সারিতে রাখতে চান অনেকে। ভারসাম্যহীন চিনি এবং লবণ গ্রহণ এই পাথর তৈরির প্রক্রিয়াতে মরার উপর খাড়ার ঘা-এর মতই কাজ করে। অতিরিক্ত ব্যায়াম কিংবা একদম ব্যায়ামহীনতাও রয়েছে এই রোগের প্রভাবক তালিকায়। এছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ইনফেকশন, গ্যাস্ট্রিক বাইপাস সার্জারি, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অভাব ইত্যাদি কারণ।
গল্পের এই পর্যায়ে পাঠকদের নিয়ে হাঁটা দেয়া যাক প্রতিরোধ এবং প্রতিকারের দুনিয়ায়। বেশি বেশি পানি পান তো করবেনই; সেই সাথে পুষ্টিকর, ভিটামিনযুক্ত ও পরিমিত খাবার গ্রহণ এবং ক্ষতিকর খাবার বর্জনের কথা এই ক্ষেত্রে উঠে আসতেই পারে। ধূমপান, মদ্যপান কিংবা এমন কোন কাজের অভ্যাস যদি থেকে থাকে যার বিরুদ্ধে আপনার নিজের বিবেকই প্রতিবাদ করে বসে, সে বিষয়ে আলাদা করে উল্লেখ করার প্রয়োজন আছে কি ? বদ অভ্যাস নাকি সুস্থ জীবন ! জীবন আপনার, সিদ্ধান্তও আপনার। একটা সময় ছিল যখন মানুষ মানুষকে সামাজিক মর্যাদা দেখে সম্মান করতো, এখনো করে। কিন্তু দিন বদলের সাথে সাথে মানুষ মানুষকে একে অপরের মস্তিষ্কের ব্যবহারের জন্য সম্মান করার প্রথাও ইতোমধ্যে চালু করে ফেলেছে। গল্পের ভিতর গল্প বলতে বলতে এন্টাসিড জাতীয় ওষুধের কথা বলতে ভুলেই গিয়েছিলাম। অপ্রয়োজনে এন্টাসিড জাতীয় ওষুধ পরিহার করুন। চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত ওষুধ গ্রহণের অভ্যাস থাকলেও তা ফেলতে হবে বাতিলের খাতায়।
প্রতিরোধের রাজ্য ছেড়ে প্রতিকারের এলাকায় যখন চলেই এলাম, তখন বলেই নেই একটু আধটু। রোগ দেখা দেয়া কিংবা সন্দেহ হবার সাথে সাথেই অতি সত্বর চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। একবিংশ শতাব্দীর নাগরিক হিসেবে টেলিমিডিসিন সেবাও গ্রহণ করতে পারেন। তবে সশরীরে চিকিৎসা গ্রহণ করা ক্ষেত্রবিশেষে অধিক ফলপ্রসূ। আর হ্যাঁ, রোগ দেখা দেয়া কিংবা সন্দেহ হবার সাথে সাথে পানি পানের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে ক্যালসিয়াম অক্সালেটযুক্ত তথা ক্ষতিকর খাবারের সাথে অন্তত কিছুদিনের জন্য আড়ি তো নিতেই পারেন। লেবুর রস, তুলসী পাতার রস, অ্যাপল সাইডার ভিনেগার, অলিভ ওয়েল ইত্যাদি এ রোগের ঘরোয়া চিকিৎসায় বেশ কার্যকরী, তবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শে নিবেন এ ক্ষেত্রে।
গল্পের একদম শেষে চলে এলাম। শেষ হয়েও হল না শেষ। পাঠককে একটি প্রশ্ন ছুড়ে দিলে কেমন হয়, “আপনার মতে ‘করোনা’ অধ্যায় থেকে পাওয়া অন্যতম শিক্ষা কী ?”। পাঠক হয়তো আমতা আমতা করে এখন একটু ভাববেন। একটু পর মুচকি হেসে উত্তর দিবেন, “ জি, আপনার আর্টিকেলের শিরোনামেই তো আছে । সচেতনতা !”
ফিচার ইমেজঃ Kristopher Roller, unplash.com
তথ্যসূত্রঃ
https://www.kidneyfund.org/kidney-disease/kidney-problems/kidney-stones/
https://www.britannica.com/topic/Hippocratic-oath
https://www.kidney.org/atoz/content/kidneystones
https://www.mayoclinic.org/diseases-conditions/kidney-stones/symptoms-causes/syc-20355755
https://www.medicinenet.com/hippocratic_oath/definition.htm
https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC3856162/
https://www.boldsky.com/health/disorders-cure/2017/home-remedies-for-kidney-stones-118586.html