বাংলা সাহিত্যের প্রবাদ পুরুষ হিসেবে হুমায়ূন আহমেদের নাম না আসলেও বিপ্লবী হিসেবে অনায়াসে তাঁকে গণ্য করা যাবে। বিপ্লবী বলাতে পাঠকের চোখে সাবলীলভাবেই ভেসে আসতে পারে চে গুভেরা, ফিদেল কাস্ত্রো, লেনিনের মতোন বিপ্লবের মহাপুরুষদের অবয়ব। হুমায়ূন আহমেদকে এঁদের সাথে মেলাতে পারছেন না কিছুতেই! মূলত বাংলা সাহিত্যে পাঠক সৃষ্টিতে হুমায়ূন আহমেদ যে অভাবনীয় পরিবর্তন এনেছেন, সেটি বিপ্লবের চেয়ে কম নয়। এক জীবনে তিনি বইপড়ুয়াদের যে স্রোত তৈরি করেছেন, তাতে ভেসে সর্বস্তরের পাঠকরা আনন্দ স্নানে মত্ত থেকেছেন, আজও আছেন। বর্তমান প্রজন্মের লেখকদের মাঝে অবধারিতভাবে চলে আসছে হুমায়ূন সাহিত্যের প্রভাব। তা নিয়ে তর্ক-বিতর্কের শেষ নেই। একটা ধারা যখন চালু হয় এবং সাহিত্যে তা প্রভাবক হয়ে দাঁড়ায়, এমনকি লেখকের চলে যাবার পরেও; তা নিয়ে রটনা না রটাই বরং অস্বাভাবিক।
একজন কিংবদন্তি কিংবা একজন হুমায়ুন আহমেদ © humayunahmedbd. com
হুমায়ূন আহমেদ কি কেবল একজন কথা সাহিত্যিক? কেবল লেখকের গণ্ডিতে তাঁকে আটকে রাখলে অন্যায় হবে, তাতে সন্দেহ নেই। বাংলা সাহিত্যে তিনি অবদান রেখেছেন, অবদান রেখেছেন শিল্পের আরও দু’টো জায়গায়। নির্মাণের মুন্সিয়ানা তিনি দেখিয়েছেন নাটক ও চলচ্চিত্র দুই ক্ষেত্রেই। ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের শেষ পর্বের কথা কারও অজানা নয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধেও তিনি বদলাননি বাকের ভাইয়ের ফাঁসির দৃশ্য। বাংলা নাটকের ইতিহাসে একমাত্র চরিত্র বাকের ভাই, যাকে বাঁচাতে মানুষ রাস্তায় নামে। কতটা আপন করে তুলে ছিল গণমানুষের আবেদন, ভাবা যায়! এর বাইরে আরেকটি ভাবনা উঁকি মারে অবচেতনে, কতটা সুগভীর নির্মাণ হলে এতটা বিদ্রোহ সম্ভব! লেখালেখি, নাটক নির্মাণে দক্ষতার পরিচয় দিয়ে হুমায়ূন আহমেদ সিনেমায় আসেন ভিন্নতা নিয়ে। অনেকের মতে অর্ডিনারি লেখক হুমায়ূন আহমেদ চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে মোটেই অর্ডিনারি ছিলেন না।
বইয়ের আদলে তৈরিকৃত সিনেমাগুলো সাধারণত বইকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না খুব একটা। এর অন্যতম কারণ, বইয়ের লেখক নিজে সিনেমা বানান না। তাছাড়া দর্শক চাহিদা, সময়ের কথা মাথায় রেখে প্রযোজক-পরিচালক তাতে পরিমার্জন করেন। সংযোজন বিয়োজন নামক ছুরি-কাঁচির নিচে পড়ে চলচ্চিত্র কখনও আবেদন হারায়, কখনওবা ছাড়িয়ে যায় মূল বইকে। ‘পথের পাঁচালী’, ‘দি সাইল্যান্স অব দ্য ল্যাম্বস’ এক্ষেত্রে মূল বইয়ের সাথে টক্কর দেওয়ার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। হুমায়ূন আহমেদের প্রথম চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমণি’ তাঁরই উপন্যাস অবলম্বনে। তাঁর সবচেয়ে বড় সুবিধা যেটি, যার সুফল ভোগ করেছে দর্শক, তা হচ্ছে নিজের কাজ নিজে করেছেন। এতে কখন কী প্রয়োজন তা সর্বোচ্চ সৌন্দর্যে ফুটিয়ে তুলতে তিনি সক্ষম।
চোখ যেনো তাঁর কথা বলতো; © humayunahmedbd. com
সত্যজিৎ রায় নিজের চলচ্চিত্রের পোস্টারও নিজে তৈরি করতেন। তিনি মনে করতেন, যে ভাবনা তাঁর মাথায় উঁকি মারছে তা অন্য কাউকে বোঝাতে চাইলেও পুরোপুরি বোঝাতে পারবেন না। হুমায়ূন আহমেদের ভাবনাও এখানে একই মোহনায় মিলে যাওয়ায় বাংলা চলচ্চিত্র পেয়েছে ‘আগুনের পরশমণি’, ‘শ্যামল ছায়া’, ‘দুই দুয়ারী’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘আমার আছে জল’, ‘ঘেটুপুত্র কমলা’র মতো দূর্দান্ত সব চলচ্চিত্র। বাংলাদেশের বড় অংশজুড়ে একাত্তর। একাত্তর ছাড়া আজকের স্বাধীন ভূ-খন্ড আমরা পেতাম না। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসে ‘জ্যোৎস্না ও জননীর গল্প’, ‘আগুনের পরশমণি’র মতো সৃষ্টি দিয়ে হুমায়ূন আহমেদ শক্তিশালী অবস্থান গড়েছেন পাঠক হৃদয়ে। রূপালি পর্দায় অভিষেক ঘটান মুক্তিযুদ্ধের ছবির মাধ্যমে। হালফিলে আমাদের দেশে যেসব মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র তৈরি হয়, গুটিকয়েক বাদে বাকিগুলোকে চলচ্চিত্র না বলে প্রহসন বলা উত্তম। পোশাক থেকে শুরু করে শুটিং সেটের অবস্থা দেখলে মনে প্রশ্ন জাগে, অহেতুক গাধাকে পিটে ঘোড়া বানানোর অপচেষ্টা কেনো করছে এরা? সেখানে হুমায়ূন আহমেদের ‘আগুণের পরশমণি’, ‘জয়যাত্রা’ কিংবা ‘শ্যামল ছায়া’ বাংলাদেশের অন্যতম সেরা যুদ্ধকেন্দ্রিক সিনেমা হিসেবে অবধারিতভাবে উচ্চারিত হবে সবার মুখে।
আগুনের পরশমণি দিয়ে চলচ্চিত্র পরিচালনায় নাম লেখান নন্দিত নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদ ; © bongobd
হুমায়ূন আহমেদের বাবা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। নানা ছিলেন শান্তি কমিটির সদস্য। দুইভাবেই দেখেছেন একাত্তরকে। দেশপ্রেমের কাছে সব তুচ্ছ, সেটি তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। শ্যামল ছায়াতে দর্শককেও উপলব্ধি করালেন। দেশপ্রেমে জাগরূক শান্তি কমিটির একজন কমান্ডার যুদ্ধাহত একটি নৌকা ও নৌকার যাত্রীদের বাঁচান। সেই নৌকাতে আবার মুসলমান হিন্দু একসাথে সফর করে। সাধারণ মুসলিম অথবা হিন্দু হলে চোখে পড়তো না, কিন্তু একই নৌকা ভাগাভাগি করে আছে মৌলভী ও গোঁড়া হিন্দু। যখন জানবেন, অস্প্রদায়িকতার মোড়কে সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে ধর্ম রীতিমতো ঢাল, সেখানে এমন কিছু সাহসিকতার প্রতিচ্ছবিই বটে। যেখানে একাত্তরে হিন্দুদের নিপীড়িত হবার পাল্লা ভারী।
হুমায়ুন আহমেদের অনবদ্য চলচ্চিত্র ‘শ্যামল ছায়া’; © bioscope
রসায়নের অধ্যাপক হুমায়ূন আহমেদেরশিল্পীদের সঙ্গে রসায়ন ছিল চমৎকার। চিত্রনাট্য নিয়ে আলোচনা করতেন শিল্পীদের সাথে। আসাদুজ্জামান নূর বলেছিলেন,
“তিনি আমাদের সঙ্গে চিত্রনাট্য ও বিভিন্ন বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করতেন, পরামর্শ চাইতেন। যদিও, আগে থেকে সম্পাদিত তার নিঁখুত কর্মে আমরা সংযোজন বিয়োজন করতে পারতাম না। সেই জায়গাটা তিনি রাখতেন না। তবু পরামর্শ চাইতেন।”
হুমায়ূন আহমেদ ও আসাদুজ্জামান নূরের চমৎকার রসায়ন মুগ্ধ করেছে দর্শকদের; © dailystar
চলচ্চিত্রে হুমায়ূন আহমেদ কতটুকু মূল্যায়ন পেয়েছেন? প্রথম ছবি ‘আগুনের পরশমণি’ তাকে এনে দেয় শ্রেষ্ঠ সংলাপ, চিত্রনাট্য ও চলচ্চিত্র, মোট তিন বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। সর্বশেষ ছবি ‘ঘেটুপুত্র কমলা’র জন্য পান শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। শুরু ও শেষ একই রেখায় আঁকা। মাঝের সময়টায় দু’হাত ভরে দিয়েছেন। কখনও নিজে, কখনও অন্যের হাত ধরে। তাঁরই উপন্যাস অবলম্বনে মোস্তাফিজুর রহমানের ‘শঙ্খনীল কারাগার’, তৌকির আহমেদের ‘দারুচিনি দ্বীপ’, মোরশেদুল ইসলামের ‘প্রিয়তমেষু’; ছবিগুলো মাথা উঁচায় পুরস্কারের মঞ্চেও।
আসা যাক বাংলা চলচ্চিত্রে হুমায়ূন আহমেদের অবদানে। মোট আটটি সিনেমা নির্মাণ করেছেন। এতেই নির্মাতা হিসেবে নিজের মুন্সিয়ানার ষোলআনা প্রয়োগ ঘটান। তাঁর ছবিগুলো নিয়ে তরুণ নির্মাতারা বসতে পারেন। আগামীর দিনগুলিতে নির্মাণ নিয়ে ভাবছেন যারা, তাদের জন্য তিনি হতে পারেন দিক নির্দেশক। ১৯৯৪ থেকে ২০১২, দেড় যুগে মোটে আটখানা ছবি পরিচালনা করেছেন, দর্শকের আক্ষেপ থাকতে পারে। দেশি সিনেমার ভগ্নদশার সময়টায় হুমায়ূন আহমেদকে প্রয়োজন ছিল। সাহিত্যে তিনি অভাববোধের জায়গাটা না রাখলেও সিনেমায় রেখে গেছেন। আমাদের সিনে সংশ্লিষ্টরা হুমায়ুন আহমেদের কাজ নিয়ে কখনও ভেবেছেন বলে মনে হয় না। মারিও পূজোর ‘গডফাদার’, সত্যজিতের ‘পথের পাঁচালী’, আকিরা কুরোসাওয়ার ‘রাশোমন’, নোলানের ‘ডার্ক নাইট’; এসব সিনেমা ফিল্ম ক্লাসের অবশ্য পাঠ্য। এসব পরিচালকদের নিয়ে আলাপ হয়, তাদের পড়ানো হয়, তাদের দর্শন বোঝানোর চেষ্টা করা হয় সিনেমা বানানোর স্বপ্ন দেখা তরুণদের। সিনেমা অনেকাংশে সমাজের দর্পন স্বরূপ। হুমায়ূন আহমেদের সিনেমার সেই আয়নায় বাঙালি দর্শক নিজেদের দেখতে পেতো।
দৃশ্যপট অঙ্কনে নির্মাতা হুমায়ুন আহমেদ প্রতিনিয়ত ছাড়িয়ে গিয়েছেন নিজেকে © daily sun
বাংলা চলচ্চিত্র ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। মৃতপ্রায় শিল্পকে বাঁচিয়ে তুলতে চাই সঠিক দিক নির্দেশনা। ভালো ভালো কাজগুলিকে তুলে ধরলে, সেসব নিয়ে আলোচনা হলে লাভটা আমাদেরই। একটা দেশ তার সংস্কৃতিকে প্রবলভাবে আঁকড়ে ধরে বাঁচে। সংস্কৃতির বড়ো একটি অধ্যায় হলো চলচ্চিত্র। আর সেই অধ্যায়ে নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদ অনায়াসে ঠাঁই পাবেন কালজয়ী হিসেবে।
ফিচার ইমেজঃ mediabangladesh. net