‘গুগল’ – এই শব্দটি পড়তে যদি আপনার ২ সেকেন্ড সময় লাগে তবে এই ২ সেকেন্ডেই গুগলে সার্চ ইঞ্জিনে প্রায় ১ লক্ষ ২৬ হাজার বার অনুসন্ধান করা হয়েছে বিভিন্ন তথ্য। প্রতি সেকেন্ডে যার পরিমাণ প্রায় ৬৩ হাজার ! অবাক হচ্ছেন ? সবে তো শুরু ! textmetrics.com এর তথ্যমতে, গুগল ইনডেক্সে প্রায় ৩ বিলিয়নেরও বেশি ওয়েবসাইট রয়েছে যা ছাপা হলে ১৩০ মাইল উঁচু কাগজের স্তুপেও জায়গা হবে না। আচ্ছা, আপনি কি এই মুহূর্তে এন্ড্রয়েড ফোন কিংবা পার্সোনাল কম্পিউটারে এই আর্টিকেলটি গুগল ক্রোম ব্রাউজারে পড়ছেন ? তাহলে বলেই ফেলি, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে পৃথিবীজুড়ে ব্রাউজার মার্কেটের ৬৪% দখল নেয়া গুগলের এই পণ্যটি প্রতি মাসে তাদের গ্রাহকদের কমবেশি প্রায় ২৫০ মিলিয়ন ত্রুটিপূর্ণ এবং ক্ষতিকর ওয়েবসাইট থেকে রক্ষা করে । চোখধাঁধানো কর্মকাণ্ডের মনমাতানো দুনিয়ায় হারিয়ে যেতে কে না চায় ? আর এখানেও গুগলের জুড়ি মেলা ভার। গুগলের পণ্যগুলো প্রতি মুহূর্তেই যেন ছাড়িয়ে যাচ্ছে নিজেদের, উপহার দিচ্ছে চমকের পর চমক। এমন অনেক চমকে চমকে ভরপুর প্রতিষ্ঠানটির অফিসগুলো বিশ্বের প্রায় ৫০টিরও বেশি দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তাদের চমকপ্রদ সব কর্মযজ্ঞের সীমানা ছাড়িয়ে। আর তাতে প্রতি বছরই সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যোগ দিচ্ছেন প্রযুক্তিসহ নানা খাতের চৌকস শিক্ষার্থীরা; যোগ দিচ্ছেন তাঁদের চোখ ধাঁধানো কর্মদক্ষতা আর তাক লাগানো কৃতিত্বের সন্নিবেশনে। এই তালিকায় পিছিয়ে নেই বাংলাদেশিরাও। আজকের গল্পে এমনই এক বাংলাদেশি তরুণ প্রকৌশলীর সাথে গল্পে গল্পে সাথে আছি আমরা, সাথে আছে টিম কিংবদন্তি।
সম্প্রতি তিনি অফার পেয়েছেন বিশ্বখ্যাত প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান গুগল থেকে; গুগলের নিজস্ব অপারেটিং সিস্টেম ক্রোম ওএস (ChromeOS) টিমে শীঘ্রই যোগদান করবেন। সৃজনশীলতা, মেধা আর পরিশ্রমের বাস্তবায়নে তিনি ইতোমধ্যেই তরুণ প্রজন্মের প্রোগ্রামারদের কাছে জনপ্রিয় এক মুখ। বলছিলাম বাংলাদেশের সাদমানের কথা, আমাদের সাদমান সাকিব। এত ব্যস্ততার মাঝেও তিনি আমাদের সময় দিয়েছেন; অসংখ্য ধন্যবাদ এবং আন্তরিক কৃতজ্ঞতার বিনীত নিবেদন তাঁর প্রতি। টিম কিংবদন্তির পক্ষ থেকে এই সাক্ষাৎজুড়ে ছিলেন ইমরান শরীফ শুভ এবং এস এম হাসানুল হক।
সদা হাস্যোজ্জ্বল সাদমান সাকিব
সাক্ষাৎকার পর্ব এবং প্রশ্নোত্তর
টিম কিংবদন্তিঃ আপনি কম্পিউটার সাইন্সে পড়তে আসার পিছনের গল্পটা যদি পাঠকদের সাথে শেয়ার করতেন…
সাদমান সাকিবঃ নটরডেম কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার একটা প্রবল ইচ্ছা জাগে। এটা মনে হয় নটরডেম কলেজের পরিবেশের একটা প্রভাব। আলাদা করে কম্পিউটার সায়েন্সেই পড়বো – এমন পরিকল্পনা ছিলো না শুরুতে। ইলেকট্রিকাল এবং কম্পিউটার সায়েন্স – দু’টো বিষয়ের উপরেই সমান আগ্রহ ছিলো। পরবর্তীতে এডমিশন টেস্টের পর বুয়েট এবং ঢাবির মধ্য থেকে বিষয়ের উপর প্রাধান্য দিয়ে ঢাবিকে বেছে নিই এবং সিএসই বিভাগে ভর্তি হই।
নটরডেম কলেজের বন্ধুদের সাথে সাদমান সাকিব
টিম কিংবদন্তিঃ প্রোগ্রামিং শেখা শুরু করেছিলেন কোন ল্যাঙ্গুইজ দিয়ে? প্রথম প্রোগ্রামিং শেখার কিছু স্মৃতিচারণ যদি করতেন! এবং প্রোগ্রামিং এর ক্ষেত্রে আপনি এখন কোন ল্যাঙ্গুইজে কাজ করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন? এক্ষেত্রে কারণ কী?
সাদমানঃ শুরু করেছিলাম সি ল্যাঙ্গুয়েজ দিয়ে। পরবর্তীতে সি++ শেখা শুরু করি, কারণ কম্পিটিটিভ প্রোগ্রামিং এর জন্যে সি++ বেশ কিছু সুবিধা দেয়।
সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করছি প্রায় ৩ বছর। নতুনদের মাঝে প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ নিয়ে যেই কৌতূহলটা থাকে, বাস্তব দুনিয়াতে ব্যাপারগুলো সেরকম না আসলে। এখানে একেকদিন একেক ল্যাঙ্গুয়েজ, ফ্রেমওয়ার্কে কাজ করতে হয়। তাই আপনার প্রোগ্রামিং দক্ষতা কতটুকু, সেটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কয়টা ল্যাঙ্গুয়েজ জানেন, সেটা কোনও বিষয় না।
টিম কিংবদন্তিঃ এসিএম আইসিপিসি (ACM ICPC) যেন প্রোগ্রামারদের এক বিশ্বকাপ! ACM ICPC নিয়ে অভিজ্ঞতা পাঠকদের সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইলো।
সাদমানঃ আমি প্রথম ICPC (Dhaka) তে অংশ নিই ২০১৭ সালে। ICPC বেশ প্রতিযোগিতামূলক প্রোগ্রামিং কনটেস্ট। প্রতি বছর দেশের সেরা দল গুলো এখানে অংশগ্রহণ করে থাকে। সেবার আমাদের দলীয় পারফরম্যান্স অতটা ভালো না হলেও পরের বছর আমরা আরও অভিজ্ঞতা অর্জন করে ICPC(Dhaka) তে অংশ নিই। এবার আমাদের দল প্রায় ৩০০ টি দলের মধ্যে দশম স্থান অধিকার করে। এর মাস দুয়েক পরেই ICPC(AMRITAPURI) তে আমরা অংশ নিই এবং প্রায় ৩০০ টি দলের মধ্যে ১৮ তম স্থান দখল করি।
টিম কিংবদন্তিঃ আপনি তো ইতোমধ্যেই প্রোগ্রামিং ইন্সট্রাক্টরের দায়িত্বও পালন করেছেন। সে সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন?
সাদমানঃ আমি প্রায় ৩ বছর ধরে প্রোগ্রামিং ইন্সট্রাক্টর এর দায়িত্ব পালন করছি। সত্যি কথা বলতে, প্রবলেম সলভিং এর পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি আমি যেই কাজটি পছন্দ করি তা হচ্ছে মেন্টরিং। প্রবলেম সলভিং, প্রোগ্রামিং ফান্ডামেন্টালস এসব বিষয়ে মেন্টরিং করাচ্ছি। সামনে ইচ্ছা আছে দেশের বাইরের সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রির জন্যে ইন্টার্ভিউ প্রিপারেশন নিয়ে মেন্টরিং শুরু করার।
সাদমানের ভালোবাসার অনেকটা জায়গা জুড়েই আছে প্রবলেম সলভিং
টিম কিংবদন্তিঃ ক্রিকেট নাকি ফুটবল? নাকি অন্যকিছু! আপনার পছন্দের খেলা কোনটি? ছোটবেলায় কোন খেলা বেশি খেলা হত? এই ব্যস্ততার মধ্যে খেলাধুলার সুযোগ হয় এখন?
সাদমানঃ আমি খেলাধুলা খুবই পছন্দ করি। কলেজ লাইফ পর্যন্ত নিয়মিত খেলাধুলা করতাম। ফুটবল এবং ক্রিকেট দুটোই আমার পছন্দের খেলা। তবে ক্রিকেটটা বেশি খেলা হতো। এলাকায় আয়োজিত টুর্নামেন্টে একবার আমাদের দল চ্যাম্পিয়নও হয়! এখন খেলাধুলার সুযোগ একটু কমে আসছে, তবে চেষ্টা করি ছুটির দিনগুলোতে খেলাধুলা করার।
টিম কিংবদন্তিঃ আপনার ক্লাস করে অনেকেই আপনার ভক্ত হয়ে গিয়েছে, ভক্তদের নিয়ে মজার কোন ঘটনা শেয়ার করা যায় কি পাঠকদের সাথে?
সাদমানঃ হাহা! একজন দক্ষ সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার এবং মেন্টর – এমন একটা পরিচয়ে পরিচিত হতে আমার দারুণ লাগে। আমার লাইফ গোল-ও অনেকটা এরকমই। মেন্টরিং এর সুবাদে আমার সাথে বয়সে ছোট-বড় অনেক মানুষের পরিচয় হয়েছে। কয়েকজন সম্পর্কে এতোটাই আপন হয়ে গিয়েছে যে রীতিমত বাসায় আসা যাওয়াও হয়! চেষ্টা করি যতটা সম্ভব যোগাযোগ রাখার, তবে সবসময় হয় না। চাকরি, পরিবার, পড়ালেখা – সবকিছু নিয়ে বেশ ব্যস্ত সময় কাটে।
ভ্রমণপ্রিয় সাদমান বরাবরই প্রকৃতির কাছে ছুটে যেতে ভালোবাসে
টিম কিংবদন্তিঃ গুগল! প্রোগ্রামারদের কাছে একটি স্বপ্নের কর্মস্থল। গুগলে ইন্টারভিউসহ আপনার গুগল যাত্রার আদ্যোপান্ত সম্পর্কে যদি জানাতেন? ভবিষ্যতে যারা গুগলে কাজ করতে চায় তাঁদের জন্য আপনার উপদেশ কী কী?
সাদমানঃ গুগলে আমি প্রথম বার আবেদন করি ২০১৯ সালে। তবে সেইবার আমার সিভিতে কিছু সমস্যা থাকার কারণে screening round এই বাদ পরে যাই। খুব একটা সিরিয়াস ছিলাম না তখন। তাই বাদ পরে যাওয়ার পরেও তেমন একটা খারাপ লাগে নাই (হাহা!)। এরপর ২০২০ সালে লিংকডইন (LinkedIn) আমার প্রোফাইল এবং প্রবলেম সল্ভিং এর অভিজ্ঞতা দেখে গুগলের একজন রিক্রুটার আমাকে নক করে এবং ইন্টার্ভিউ এর জন্যে আমন্ত্রণ জানায়। এখানে বলে রাখা ভালো, এর আগে বেশ কিছু অনলাইন এবং অফলাইন নিউজ পোর্টালে একটা ভুল তথ্য প্রকাশিত হয় যে রেফারেল ছাড়া এপ্লাই না করার কারণে আমার আবেদনগুলো নাকচ করে দেয়া হয়। তথ্যটি আসলে সত্য নয়। আপনি যদি যথেষ্ট skillset না অর্জন করতে পারেন, শত রেফারেলেও কোন কাজ হবে না।
আমার ইন্টার্ভিউ ২ মাস লম্বা সময় নিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। প্রথমে রিক্রুটার স্ক্রিনিং রাউন্ড হয়। এখানে কম্পিউটার ফান্ডামেন্টালস এবং ডাটা স্ট্রাকচার এলগোরিদম এর উপর বেশ কিছু প্রশ্ন করা হয় আমাকে। এরপর এই রাউন্ড পাশ করার পরে গুগল ফোন রাউন্ড নেয়া হয়। ৪৫ মিনিটের এই রাউন্ডে গুগল মিটে আমাকে একজন গুগলের সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার ২টি প্রোগ্রামিং সমস্যার সমাধান করতে দেন। কোড করতে হয় গুগল ডকের মত একটা প্লাটফর্মে। শুধু সমস্যা সমাধানই এখানে যথেষ্ট নয়। আপনি ঠিকমত সমাধানটি ইন্টারভিউয়ার কে বুঝাতে পেরেছেন কিনা, আপনার যোগাযোগ দক্ষতা কেমন সবকিছু এখানে যাচাই বাছাই করা হয়। ২টি প্রোগ্রামিং প্রবলেম আমি ৩০ মিনিটেই সমাধান সম্পন্ন করে ফেলি। বাকি ১৫ মিনিট গুগলের বিভিন্ন প্রোজেক্ট নিয়ে ইন্টারভিউয়ার এর সাথে কথাবার্তা হয়।
আমি বেশ কনফিডেন্ট ছিলাম। ২ দিন পর জানতে পারি আমার ইন্টার্ভিউ ফিডব্যাক পজিটিভ এবং তারা অনসাইট (ফাইনাল) রাউন্ডে যেতে যায়। অনসাইট রাউন্ডটি ভার্চুয়ালি হয়। এখানে ৩টি কোডিং রাউন্ড এবং ১টি গুগলিনেস রাউন্ড (Behavioural Round) হয়। তুলনামূলকভাবে এই রাউন্ডগুলো আগের রাউন্ডগুলোর তুলনায় বেশ কঠিন! তবে আল্লাহ রহমতে একটা রাউন্ড বাদে বাকি সবগুলো রাউন্ডই খুব ভালো হয়।
প্রায় ১ মাস পর জানতে পারি, আমার অনসাইট রাউন্ডের ফিডব্যাক পজিটিভ এবং তারা আমাকে নিয়ে হায়ারিং কমিটির কাছে যেতে চায়। তারপর আরো ১-২ সপ্তাহ যায় এভাবে। হায়ারিং কমিটির এপ্রুভাল পাওয়ার পর, প্রায় ৪-৫ টা টিমের সাথে আমার টিম ফিট টক হয়। সেখান থেকে ChromeOS টিমকে আমি বেছে নিই। অবশেষে আগস্ট এর প্রথম সপ্তাহে আমি অফার লেটার পাই। প্রতিটা স্টেপ এখানে নক-আউট স্টেপ। একটিতে বাদ পরে যাওয়া মানে পুরো প্রক্রিয়া থেকে বাদ পরে যাওয়া।
যারা ভবিষ্যতে গুগলে কাজ করতে চান তাদের উদ্দেশ্যে আমার একটাই কথা, লেগে থাকতে হবে এবং কঠোর পরিশ্রমী হতে হবে। প্রবলেম সল্ভিং এবং এনালিটিকাল স্কিলটাই গুগলে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয়। আপনি কয়টা ল্যাঙ্গুয়েজ বা ফ্রেমওয়ার্ক জানেন, তারা এসব কেয়ারও করে না।
টিম কিংবদন্তিঃ আপনার জন্ম, বেড়ে ওঠা, পরিবার, স্কুল কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় জীবন সম্পর্কে যদি পাঠকদের সাথে কিছু শেয়ার করতেন?
সাদমানঃ আমার জন্ম নরসিংদীতে। তবে বেড়ে ওঠা, পরিবার, স্কুল কলেজ সবকিছু ঢাকায়। আমি আমার স্কুল জীবন সম্পন্ন করি মনিপুর স্কুল থেকে। কলেজ ছিলো ঢাকার নটরডেম কলেজ। ২০১৪ সালে এইচ এস সি এবং বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু করি ২০১৫ তে। পরিবারে আমরা ৩ ভাই বোন, বাবা-মা এবং আমার স্ত্রী। বাবা মারা যান ২০১৭ সালে।
পারিবারিক অনুষ্ঠানে সাদমান সাকিব
টিম কিংবদন্তিঃ শিক্ষা জীবনের মজার কিছু স্মৃতি নিয়ে কিছু বলবেন কি?
সাদমানঃ শিক্ষা জীবন এখনো চলছে। এর শেষ নেই। প্রতিনিয়ত শিখছি। আলাদা করে মজার কিছু স্মৃতি তেমন মনে পড়ছে না। (আমার আসলে তেমন কিছু মনেও থাকে না, হাহা!)
টিম কিংবদন্তিঃ প্রোগ্রামিংয়ে আপনার অনুপ্রেরণা ( ব্যক্তি / শিক্ষক / … )
সাদমানঃ হাসনাইন হেইকেল স্যার শিখিয়েছেন প্রোগ্রামিং কতোটা আনন্দদায়ক হতে পারে! ডিপার্টমেন্ট এর ভাইয়ারা এবং জুনিয়রদের দেখেও প্রোগ্রামিং এবং প্রবলেম সল্ভিং এ আগ্রহ পেয়েছি। তন্ময় ভাই, সজীব ভাই, মেসবাহ, ঋদ্ধ – এদের কথা না বললেই না। এরকম আরো অনেকেই আছে, বন্ধু-বান্ধব, সিনিয়র-জুনিয়র, শিক্ষক।
টিম কিংবদন্তিঃ আপনার কর্মজীবনের শুরুর গল্পটা পাঠকদের সাথে শেয়ার করবেন ?
সাদমানঃ ২০১৯ এর এপ্রিলে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগদান করি স্যামসাং এ। প্রথম জব নিয়ে খুব নার্ভাস ছিলাম কেন যেন। তবে প্রথম যেদিন অফার লেটারটা মেইলে আসে, আনন্দে দিশেহারা হয়ে যাই। এ দেশে চাকরির বাজার নিয়ে অনেকেরই ধারণা আছে। তেমন কিছুই আমার মধ্যে কাজ করতো।
প্রায় ২ বছর সেখানে কাজ করে, চলে আসি পেন্টা গ্লোবাল লিমিটেডে সফটওয়্যার ডেভেলপার হিসেবে। সত্যি বলতে এখানে কাজ করে দারুন আনন্দ পাচ্ছি। কাজের ক্ষেত্র বেশ বড় হওয়ায় আনন্দটা আরো বেশি কাজ করে এখানে।
টিম কিংবদন্তিঃ শিক্ষার্থী হিসেবে সাদমান সাকিব এবং শিক্ষক বা কোচ হিসেবে সাদমান সাকিব; আপনি কোনটি বেশি উপভোগ করেন এবং কী কারণে?
সাদমানঃ অবশ্যই শিক্ষক হিসেবে! কারণ শিক্ষার্থী হিসেবে থাকার আনন্দটা সবচেয়ে বেশি। আপনি যখন শিক্ষক বা কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন, তখন আপনি নিজেই একজন শিক্ষার্থী। যেখানে আপনি নিজে শিখেন এবং একইসাথে শেখান।
টিম কিংবদন্তিঃ গুগলে আপনার প্রজেক্ট সম্পর্কে যদি একটু বলতেন?
সাদমানঃ আমি এখনও জয়েন করি নি। তবে গুগলের নিজস্ব অপারেটিং সিস্টেম ক্রোম ওএস (ChromeOS) টিমে আমি যোগদান করবো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে হাসিখুশি সাদমান
টিম কিংবদন্তিঃ প্রোগ্রামিং-এর ক্ষেত্রে অনেকের কাছেই আপনি এক অনুপ্রেরণার নাম; বিশেষ করে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের প্রোগ্রামার কাছে তো এক ইয়ুথ আইকন-ই বটে । ভবিষ্যতে যারা প্রোগ্রামিং এর জগতে এ আসতে ইচ্ছুক, তাঁদের উদ্দেশ্যে যদি কিছু বলতেন?
সাদমানঃ প্রোগ্রামিং শেখার ক্ষেত্রে ধৈর্য এবং সঠিক পরিকল্পনার কোনো বিকল্প নেই। Quick output বলতে এখানে কিছু নেই। তাই যারা ভবিষ্যতে প্রোগ্রামিং এর জগতে আসতে চাচ্ছেন, তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাইঃ প্রবলেম সল্ভিং ছাড়া শুধু ল্যাঙ্গুয়েজ বা ফ্রেমওয়ার্ক শিখে বেশিদূর যাওয়া যাবে না। বেসিকে বেশি জোর দিতে হবে।
টিম কিংবদন্তিঃ আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে পাঠকদের সাথে কিছু শেয়ার করা যায়?
সাদমানঃ আছে। বেশ কিছু আছে। ইন শা আল্লাহ আগামীবছর জানাবো। এখন একটু গোপনই থাক!
স্বপ্নটা আকাশ ছোঁয়ার
সাক্ষাৎপর্বে সাদমান সাকিবের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মুগ্ধতা ছড়াচ্ছিলো। আমরাও আরও কিছু প্রশ্ন করার লোভ সামলাতে পারলাম না। আমাদের আবদার রাখতে তিনি সেই প্রশ্নগুলোর উত্তরও দিলেন হাসিমুখে।
টিম কিংবদন্তিঃ একজন শিক্ষার্থী যে বিস্তারিত না জেনে শুধু বাহ্যিক চাকচিক্য দেখে ভালো সাবজেক্ট মনে করে সিএসই নিয়ে ফেলেছে, এবং কিছুদিন যাওয়ার পর তাল মিলাতে না পেরে চরম মাত্রায় ডিপ্রেসড, এমন কারও জন্য আপনার পরামর্শ কী হবে?
সাদমান সাকিবঃ প্রতিটা বিষয় আনন্দের এবং সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তবে আপনার কাছে প্রতিটা বিষয় সমানভাবে ভালো লাগবে – এটা সত্য নয়। নিজের আগ্রহের সাথে মিল রেখে সাবজেক্ট পছন্দ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা উচিত। আজ থেকে ৬ বছর আগে যদি বিশ্ববিদ্যালয় দেখে আমি বুয়েটে চলে যেতাম, হয়তো এভাবে আজকে কথা বলার সুযোগ নাও হতে পারতো! ( হা হা ! )
টিম কিংবদন্তিঃ অ্যাকাডেমিয়া আর ইন্ডাস্ট্রি কোনটাকে এগিয়ে রাখবেন? অথবা কেউ যদি বিসিএস, ব্যাংক বা অন্য কোনো জবে যেতে চায় সেটাকে কীভাবে দেখবেন?
সাদমানঃ দু’টোই তো গুরুত্বপূর্ণ! দু’টোর কাজ করার ক্ষেত্র সম্পূর্ণ আলাদা! ভালো একাডেমিয়া না হলে হয়তো আমি উঠেই আসতে পারতাম না। আমার কিন্তু আগ্রহের জায়গা ইন্ডাস্ট্রি!
অবশ্যই ভালো চোখে দেখবো। যার যার যেটা পছন্দ সে সেটাতে কাজ করুক, এতে তো কোনো ক্ষতি নাই। তবে নিজের পছন্দ এবং সময় নিয়ে সবসময় সচেতন থাকা উচিত। আর দুনিয়া এখন কীভাবে চলছে, দেশ কীভাবে চলছে সেসব বিষয়ে একটু সজাগ থেকে ক্যারিয়ার পছন্দ করাটা আমার কাছে বুদ্ধিমানের মতো সিদ্ধান্ত মনে হয়।
টিম কিংবদন্তিঃ বাইরের কর্পোরেট কালচারের তুলনায় দেশের এই সেক্টরের বেশ বদনাম খেয়াল করা যায়, এ ব্যাপারে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি যদি শেয়ার করতেন…
সাদমানঃ সত্যি কথা বলতে, আমাদের দেশে লার্জ স্কেলে কাজ হয় খুবই কম! টেক সেক্টরকে যদি আপনি অন্যান্য সেক্টরের সাথে মিশিয়ে চিন্তা করেন তাহলে একটু ভুল হবে। আমাদের ফ্লেক্সিবল একটা ওয়ার্ক এনভাইরনমেন্ট দরকার হয়। না হয় জটিল সমস্যার সমাধান করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব খুব ভোগায়।
আমাদের দেশে আইটি সেক্টরের অনেক উজ্জ্বল সম্ভাবনা আছে। তবে এটা সম্পূর্ণ নির্ভর করছে সেক্টরটাকে কীভাবে আমরা ম্যানেজ করি তার উপর। আপনি যদি ঠিকভাবে আপনার দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎগুলোকে ব্যবহার করতে না পারেন, তারা থাকবে না। হিসেবগুলো এরকমই সহজ।
বন্ধুদের সাথে ঘুরে বেড়ানোটাও সাদমানের ভীষণ পছন্দের
টিম কিংবদন্তিঃ আমরা জানি, আপনার বাবার সাথে আপনার অনেক অনেক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, তার ব্যাপারে এমন কিছু কি শেয়ার করা যায়? যা আপনাকে নিয়ত তার শূন্যতা মনে করিয়ে দেয়। অথবা তার সাথে কোনো নস্টালজিক স্মৃতি…
-> আব্বা গণিত খুব পছন্দ করতেন। আমার গণিতে হাতেখড়ি আব্বার কাছ থেকেই। আমার প্রবলেম সল্ভিং এর মোক্ষম সময় ছিলো রাতের বেলা। আব্বা প্রায়ই উঠে এসে বসে থাকতেন আমার রুমে এবং দেখতেন আমি কী কী করি। মাঝেমাঝেই গুগল বা এরকম টেক জায়ান্টগুলো নিয়ে জিজ্ঞেস করতেন। আব্বা আজকে সাথে থাকলে অন্যরকম ভালো লাগতো। তবে আমি নিশ্চিত, আব্বা সবকিছুই জানতে পেরেছেন।
টিম কিংবদন্তিঃ প্রোগ্রামিং অবশ্যই কঠিন একটা কাজ, এখানে দিনের পর দিন হাল না ছেড়ে দিয়ে মনোবল ধরে রাখার পেছনে মোটিভেশন হিসেবে কী কাজ করেছে?
সাদমানঃ মোটিভেশন বলবো না। আমি বলবো প্রোগ্রামিং শুধু ভালো লাগা থেকে করে গিয়েছি। যখন কোনোকিছু আপনার ভালো লাগে, তখন এমনি সেটা আর ছাড়তে ইচ্ছা করে না । ( হাহা ! )
পুরো সাক্ষাৎকারজুড়ে সাদমান সাকিবের বিমুগ্ধ শ্রোতা ছিলেন টিম কিংবদন্তি’র দুই সদস্য; হাসান ও ইমরান
প্রোগ্রামিং জগতে নতুন প্রজন্মের পদচারণা ক্রমশই বাড়ছে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। স্যার চার্লস উইলিয়াম ব্যাবেজ (২৬শে ডিসেম্বর, ১৭৯১ – ১৮ই অক্টোবর, ১৮৭১) -এর সাথে পৃথিবীর প্রথম প্রোগ্রামার সম্মানে ভূষিত অ্যাডা লাভলেস(১০ই ডিসেম্বর,১৮১৫- ২৭শে নভেম্বর,১৮৫২) যখন অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিন বা ডিফারেন্স ইঞ্জিন নামক আদি কম্পিউটার আবিষ্কারের নেশায় ডুবে ছিলেন তখন কি তিনি ঘুণাক্ষরেও আঁচ করতে পেরেছিলেন, কি এক অত্যাশ্চর্য রাজ্যের সন্ধান তিনি বিশ্ববাসীকে দিতে চলেছেন, যার বদৌলতে বদলে যাবে ভবিষ্যতের পৃথিবী? প্রযুক্তি দুনিয়া বদলাচ্ছে, বদলে যাচ্ছে আমাদের এই বিশ্বজগৎ-ও। প্রযুক্তির এই সাদমান সাকিবদের যাত্রা শুভ হোক, প্রোগ্রামিং-ভীতিকে প্রোগ্রামিং-প্রীতিতে রূপান্তরিত করুক আমাদের তরুণ প্রজন্ম, আমাদের নতুন প্রজন্ম, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।সেদিন খুব বেশি দূরে নেই যেদিন প্রোগ্রামিং দুনিয়ায় রাজত্ব করবে বাংলাদেশিদের আবিষ্কার করা কোন প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুইজ, দেখাবে এক নতুন আলোর পথ; যে আলোয় বদলে যাবে আগামীর প্রযুক্তি বিশ্বের গতিপথ।
কৃতজ্ঞতাঃ সাদমান সাকিব,সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, গুগল।
সাক্ষাৎকার টিমঃ ইমরান শরীফ শুভ, এস এম হাসানুল হক।
ফিচার ছবিসহ আর্টিকেলে ব্যবহৃত সকল ছবি’র জন্য সাদমান সাকিবের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।
তথ্যসূত্রঃ
১. https://blog.hubspot.com/marketing/google-search-statistics
২.https://www.vpncrew.com/google-chrome-interesting-stats-facts/