“বাই দি অর্ডার অব পিকি ব্লাইন্ডার্স”। আপনি যদি সিরিজপ্রেমী হয়ে থাকেন, তবে এই বাক্যটির সাথে আপনার অপরিচিত থাকার কথা নয়। ওভারকোট গায়ে, মাথায় ফ্ল্যাট ক্যাপ পরিহিত, মুখে সিগারেটধারী থমাস শেলবীর নেতৃত্বে চলা বার্মিংহামের এক গ্যাংস্টার দলের রাজত্বের কাহিনী নিয়ে তৈরি পিকি ব্লাইন্ডার্স সিরিজটি। ২০১৩ সালে শুরু হওয়া এই সিরিজটির গল্পটা কাল্পনিক হলেও পিকি ব্লাইন্ডার্স নামের দস্যুদলের অস্তিত্ব কিন্তু কাল্পনিক নয়। উনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে এই নামেরই একটি দল ত্রাস ছড়িয়ে বেড়াচ্ছিল বার্মিংহামের রাস্তায়।
দলটির নাম পিকি ব্লাইন্ডার্স কী করে হলো, এ নিয়ে কিছুটা ধোঁয়াশা রয়েছে। কারো মতে, নিজেদের ফ্ল্যাট ক্যাপের আগায় (ইংরেজিতে Peak) রেজর ব্লেড সেলাই করা থাকতো বলেই গ্যাংটির নাম এমন। কেউবা আবার বলেন ক্যাপের সাহায্যে নিজের চেহারা ভিক্টিমের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখত বলে দলের এই নামকরণ। তবে রেজর ব্লেডের কারণে নামকরণের ব্যাপারটিকে মিথ বলে মনে করেন ঐতিহাসিক কার্ল চিন। কারণ তখন মাত্রই ব্লেডের ব্যবহার শুরু হয়েছিল। যে কারণে সেগুলোর দাম ছিল বেশ চড়া।
তৎকালীন ইংল্যান্ডের অন্যান্য গ্যাংস্টার দলগুলোর মতো পিকি ব্লাইন্ডার্স উত্থানের কারণও উনবিংশ শতাব্দীর শিল্প অধ্যূষিত দেশটির দারিদ্র্য এবং অর্থনৈতিক দুরাবস্থা। অর্থকষ্টের কারণেই গড়ে ওঠে ছোট ছোট কতগুলা গ্যাং যার সদস্য ছিল কমবয়সী ছেলেরা। এই অবস্থা বেশি খারাপ ছিল মিডল্যান্ড এবং উত্তর ইংল্যান্ডের বস্তি এলাকাগুলোতে। টাকা এবং চাকরি বাকরির অভাবে পকেট মারা, ছিনতাইসহ বিভিন্ন ছোটখাট অপরাধকর্মই ছিল তাদের আয়ের উৎস।
দেশের যখন এমন অবস্থা, তখন ১৮৯০ সালের মার্চে পত্রিকায় আসে এক ব্যাক্তির উপর নৃশংস হামলার। বার্মিংহামের স্মল হিথ নামের এক এলাকায় ঘটে ঘটনাটি, যে ঘটনাটি ঘটিয়েছিল পিকি ব্লাইন্ডার্স। গ্যাংটি ইতোমধ্যেই নিজেদের সহিংসতা এবং নৃশংসতার জন্য কুখ্যাত ছিল। এবার পত্রিকায় নিজেদের নাম ছাপিয়ে বেশ ঢালাওভাবে নিজেদের উপস্থিতির জানান দেয় তারা।
আঠারশ দশকের শেষ দিকে গড়ে উঠা এই গ্যাংগুলোর সদস্যদের বয়স ছিল ১৮ থেকে শুরু করে ৩০ বছর পর্যন্ত। বেশ কিছু গ্যাংয়ের অনেক সদস্য হয়ে উঠেছিল বেশ প্রভাবশালী। যার অনন্য উদাহরণ হলো পিকি ব্লাইন্ডার্সের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য থমাস গিলবার্ট যাকে সবাই চেনে কেভিন মুনি হিসেবে।বার্মিংহামের রাস্তায় রাস্তায় যখন ইয়াং গ্যাং গড়ে উঠার চল শুরু হলো, সেই সাথে শুরু হলো ভূমি দখলের লড়াই। এই জায়গা দখল নিয়েই মারামারি শুরু হলো গ্যাং গুলোর মাঝে। এই লড়াই উস্কে দেয়ায় মুখ্য ভূমিকা ছিল এই কেভিন মুনিরই।
এর মধ্য দিয়ে পিকি ব্লাইন্ডার্স খুব দ্রুত হয়ে উঠল বার্মিংহামের অন্যতম প্রভাবশালী গ্যাং। নিজেদের সুবিধামত এলাকা বেছে নিয়ে সেখানে রাজত্ব শুরু করলো তারা। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল চিপসাইড এবং স্মল হিথ এলাকা। এই এলাকা দখল করতে যেয়ে পিকি ব্লাইন্ডার্সদের মুখোমুখি হতে হলো “চিপসাইড স্লগার” গ্রুপের। প্রায়ই লড়াই লেগে যেত এই এই দুই দলের মাঝে। শেষমেষ তাদের মিট্মাট হলো নিজেদের মতো করে এলাকাভাগের মধ্য দিয়ে।
পিকি ব্লাইন্ডার্স দিনকে দিন আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠছিলো। এর কারণ ছিল আইন থেকে শুরু করে ব্যবসা পর্যন্ত সবাই টাকার বিনিময়ে ছিল ব্লাইন্ডার্সদের হাতে। ফলে অপরাধের জন্য খুব একটা শাস্তির মুখোমুখি হওয়া লাগতো না তাদের।
১৮৯৯ সালে একজন আইরিশ পুলিশ কনস্টেবলকে বার্মিংহামে নিয়োগ দেয়া হয় পিকি ব্লাইন্ডার্সদের থামানোর জন্য। বলা বাহুল্য, এই চেষ্টা সফল হয়নি। পুলিশ ডিপার্ট্মেন্টের ভিতরেই দুর্নীতির কারণে পিকি ব্লাইন্ডার্সদের আটকানোর চেষ্টা ব্যর্থ হয়। টাকার জোরে আইন ব্যবস্থাকে নিষ্ক্রিয় করে রেখে ব্লাইন্ডার্সরা দেদারসে চালিয়ে যাচ্ছিল নিজেদের অবৈধ কর্মকান্ড। ঘুষ আর সহিংসতাকে সম্বল করে এলাকায় ক্ষমতার চূড়ায় ছিল এই পিকি ব্লাইন্ডার্স। অর্থনৈতিক হোক, সামাজিক হোক কিংবা হোক রাজনৈতিক- সব সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা ছিল এই গ্যাংয়ের হাতে।
পিকি ব্লাইন্ডার্সরা যে কেবল ক্ষমতার দিক দিয়েই সেরা ছিল তা নয়। বেশভূষার দিক দিয়েও তারা ছিল অন্যদের চেয়ে আলাদা। মাথায় ফ্ল্যাট ক্যাপ, চামড়ার বুট জুতা, ওয়েস্টকোট, আলাদাভাবে সেলাই করা জ্যাকেট ছিল পিকি ব্লাইন্ডার্স দলের সদস্যদের পোষাক। এই বেশভূষার উদ্দেশ্য ছিল তিনটা। প্রথমত, অন্যান্য গ্যাং থেকে নিজেদের আলাদাভাবে চেনানো। দ্বিতীয়ত, আইন যে তাদের হাতের মুঠোয় এটা জনগণকে বোঝানো। কারণ সবার মাঝে আলাদা করা গেলেও পুলিশ পিকি ব্লাইন্ডার্সদের কিছুই করতে পারবে না।
ক্ষমতা বাড়তে থাকায় পিকি ব্লাইন্ডার্সরা তাদের অপরাধের পরিধিও আরও বাড়াতে থাকলো। ডাকাতি, অবৈধ পাচার, নিরাপত্তা ব্যূহ, প্রতারণা, ছিনতাইসহ আরও নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়তে থাকে দলটির সদস্যরা। এত ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ডের পরও পুলিশের হাত ছিল বাঁধা। ১৯০৪ সালের অক্টোবরে চুরির দায়ে গ্রেফতার হয় হ্যারি ফাউলস, স্টিফেন ম্যাকনিকেল, আর্নেস্ট হাইনস। কিন্তু পুলিশ বেশিদিন তাদের আটকে রাখতে পারেনি। একমাসের মাথায় ছাড়া পেয়ে আবার পুরাতন কাজকর্মে জড়িয়ে পড়ে তারা। মিডল্যান্ড পুলিশের রেকর্ড ঘেটে দেখা যায় সেই সময় চুরি-ডাকাতির কেস বেড়ে গিয়েছিল বহুগুণে। তের বছর বয়সী ডেভিড টেইলরের নামে মামলা হয় অস্ত্র বহন করায়। এই গ্যাংয়ের কাজকর্মে নাভিশ্বাস উঠে গিয়েছিল পুলিশের।
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে এই অপরাধের প্রবণতা আরও বেড়ে গিয়েছিল। বিশ বছর ধরে বার্মিংহামের রাস্তা দাপিয়ে বেড়ানোর পর দলটি নজরে পড়ে ‘দ্য বার্মিংহাম বয়েজ’ নামের গ্যাংয়ের, যা পিকি ব্লাইন্ডার্স দলটির জন্য সুবিধার ছিল না মোটেও। ঘোড়দৌড়ে পিকি ব্লাইন্ডার্সরা নিজেদের ঘাটি গাড়তে গেলে তাদের মুখোমুখি হতে হয় বার্মিংহাম বয়েজদের। বিলি কিম্বারের নেতৃত্বে চলা এই গ্যাংটির সাথে তুমুল সংঘর্ষের পর তাদের কাছে বার্মিংহামের দখল হারায় পিকি ব্লাইন্ডার্সরা। তবে অন্যান্য গ্যাংদের উত্থানের কারণেই যে তারা বিলীন হয়ে গেছে এমনটি নয়। পুলিশী তৎপরতা এবং শাস্তির পরিমাণ আরও বেড়ে যাওয়ার কারণে অনেকেই গ্যাং ছেড়ে চলে যায়। দলের অনেক সদস্যরা পরিবার পরিজন নিয়ে বার্মিংহামের রাস্তা ছেড়ে চলে যায় গ্রামাঞ্চলের দিকে। সময়ের সাথে ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যায় পিকি ব্লাইন্ডার্সদের ক্ষমতা।
পিকি ব্লাইন্ডার্সের এই কুখ্যাত কীর্তিনামা থেকে স্টিভেন নাইট লিখেন পিকি ব্লাইন্ডার্স সিরিজের গল্প। হিস্ট্রি এক্সট্রা কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে নাইট জানান, তাঁর বাবার চাচা শেলডন পরিবার ছিল পিকি ব্লাইন্ডার্সদের দলের ছোট একটি অংশ। নিজের বাবার কাছে শোনা গল্প থেকেই নাইটের মাথায় আসে টিভি সিরিজটির আইডিয়া।
“আমার বাবার কাছে একটি গল্প শুনেই আমি পিকি ব্লাইন্ডার্স লেখার ব্যাপারে মনস্থির করি। তার বাবা একবার তাকে একটি চিরকুট দিয়ে বলেছিলেন, ‘যাও, তোমাদের চাচাদের কাছে এটা দিয়ে আসো।‘ বাবা রুমের দরজার কড়াঘাত করে ঢুকেন। দেখতে পান ভালো পোশাক পরা আটজন লোক বসে আছে টেবিলে। সবার মাথায় ক্যাপ আর পকেটে বন্দুক। টেবিল ভর্তি ছিলো টাকা।“, হিস্টোরি এক্সট্রা কে বলেন স্টিভেন নাইট। “এই ছবিটাই- ধোঁয়া, মদের মাঝে পরীপাটি সেজে কয়েকজন লোক বসে আছে বার্মিংহামের এক বস্তিতে। এই মিথোলজি, এই গল্প থেকেই আমি শুরু করে দিলাম আমার লেখা।“ ২০১৩ সালে থেকে বিবিসি টু তে শুরু হয় পিকি ব্লাইন্ডার্স নামের টিভি সিরিজ। সিরিজের পটভূমি ১৮৯০ সালের এই পিকি ব্লাইন্ডার্স নিয়ে হলেও সিরিজে দেখা যায় ১৯১৯ সালের প্রেক্ষাপটে এর গল্প। কিলিয়ান মার্ফি, হেলেন ম্যাকক্রোরি, পল এন্ডারসন, টম হার্ডি অভিনীত এই সিরিজটি এখন পর্যন্ত প্রচারিতে হয়েছে পঞ্চম সিজন পর্যন্ত। আসছে ষষ্ঠ সিজন। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে এটিই হবে সিরিজের শেষ সিজন।
Reference: