তাকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, অস্কার পেলে কোথায় রাখবেন? তিনি জবাব দিয়েছিলেন, ‘নিশ্চয়ই বাথরুমে রাখব না। এটি তার নিজের জায়গা খুঁজে নেবে।’ তিনি অস্কার পাননি, তবে তার দুটো ছবি উঁচিয়ে ধরেছিল চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ সম্মাননা।
অস্কারের সঙ্গে সখ্যতা তার পুরনো। ১৯৮৮ সালে অভিষেক সিনেমা অস্কারের জন্য মনোনয়ন পায়। সেই তাকে সর্বশেষ ৯৩ তম অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডে স্মরণ করা হয় প্রয়াত আরও অনেক নামী তারকার সঙ্গে! বলা হচ্ছিল ইরফান খানের কথা। পুরো নাম সাহেবজাদে মোহাম্মদ ইরফান আলী খান। বলিউডের অভিনেতা বললে ভুল হবে, বিশ্ব চলচ্চিত্রের অন্যতম সমীহ জাগানিয়া অভিনেতা তিনি। ২০২০ সালের ২৯ এপ্রিল, ভক্তদের কাঁদিয়ে পরপারে পাড়ি জমালেও অমর হয়ে থাকবেন দূর্দান্ত অভিনয় গুণে।
ইরফান শুরু থেকেই অভিনেতা। দিল্লীর ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা, অভিনয়ে ক্যারিয়ার গড়তে চাওয়াদের কাছে যা তীর্থস্থান। সেখানে ভর্তির আগে ভাইবা বোর্ডে ইরফানের কাছে জানতে চাওয়া হয়, অভিনয়ের পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে কি-না? জবাব দিলেন, হ্যাঁ! আদতে তা মিথ্যে ছিল। বাঘা বাঘা মানুষের সামনে ভাইবা বোর্ডে মিথ্যা বললেন, তারা গিলেও নিল; অভিনয়ের শুরুটা এরচেয় জম্পেশ হতে পারতো না!
বলিউডে এমন এক সময়ে তার আগমন, অফট্র্যাক সিনেমা লোকে দেখে না বললে চলে! জেনেশুনে এগিয়েছেন। সাফ জানান- ‘যেদিন থেকে স্রোতে গা ভাসাব, সেদিন থেকে মৃত্যু হবে আমার অভিনেতা সত্তার।’ সত্তাকে মরতে দেননি, জীবনের শেষ অবধি! টায়ার ব্যবসায়ী বাবার ব্যবসায়ে মনোনিবেশ করেননি। নামী পরিবারের সন্তান ছিলেন, ক্রিকেটটা চেখে দেখেছেন। ভারতের প্রথম টেস্টের অধিনায়ক সি কে নাইড়ুর নামে চলা সি কে নাইড়ু টুর্নামেন্টের জন্য সিলেক্ট হয়েছিলেন রাজ্য দলে, চালিয়ে যাননি খেলা। মাথায় ঢোকো অভিনয়ের পোকা, চলে আসেন দিল্লী, ভর্তি হন ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামায়। জীবনের অনেক রঙের প্রথম রঙ দেখার শুরু হয় এরপর।
শুরুর দিকে কাটিয়ে দেন টিভি সিরিয়ালে অভিনয় করে। প্রায় এক দশকের মতোন কেটেছে ছোটোপর্দায়। সাফল্য ওভাবে আসেনি। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক মীরা নায়ার তার সিনেমায় কাস্ট করালেন, এরপর বাদ দিয়ে দিলেন। তারচেয়েও ব্যাপার ভয়ংকর হলো, নাটকে কাজ করার পর পেমেন্ট পান চুক্তির অর্ধেক! ম্যানেজমেন্টের যুক্তি, অভিনয় খারাপ হয়েছে! একজন অভিনেতার অভিনয় খারাপ হতেই পারে, এর বদলে টাকা কেটে নেওয়ার মতো অপমান দ্বিতীয় কিছু নেই। একটা সময় হাঁপিয়ে ওঠেন ইরফান।
এরপরও পিছু ফিরতে হয়নি তাকে। কারণ তিনি কখনো চাননি একশো মিটারে দৌঁড়াতে। বরাবরই ম্যারাথনে নেমেছেন। সাফল্য এসেছে মজবুতভাবে। চরিত্রের গভীরে ঢুকে মিলেমিশে একাকার হবার ক্ষমতা সবার থাকে না। ইরফান কখনোই নায়ক ছিলেন না। তিনি ছিলেন সেই ব্যক্তি যাকে দিয়ে পরিচালক গল্প বলাতে চাইতেন। তিনিও নিদারুণ আন্তরিকতায় সেসব গল্প বলে যেতেন। আমরা মুগ্ধ হতাম।
হিন্দি মিডিয়ামের অশিক্ষিত রাজ বাত্রার সিনেমার শেষাংশে বলা কথায়, লাইফ ইন অ্যা মেট্টোর মন্টির সহাস্য বিচরণে, কারওয়ার হেঁয়ালি বড়ভাই, পিকুর রানা, বিল্লু বারবারের বিল্লু কিংবা পান সিং তমারের সংগ্রামী পান সিং জীবনকে চিনতে শিখিয়েছে। ডুব সিনেমা বিতর্কিত হলেও ফারুকী সকলের ধন্যবাদ পেয়েছেন ইরফানকে দিয়ে বাংলা বলানোয়। অভিনয়ের মুন্সীয়ানার সুবাস খানিকটা পেয়েছে আমাদের ফিল্মপাড়াও। দ্য লাঞ্চবক্স, যে সিনেমার জন্য নোলানকে মানা করেন সেটি ভক্তদের হৃদয়ে গেঁথে থাকবে আজীবন। ইরফান বেঁচে রবেন পর্দায় নিজেকে উপস্থাপন করানো প্রতি সেকেন্ডে, প্রতি পদক্ষেপে। হয়ে উঠেছেন ভক্তদের আত্মার আত্মীয়।
যে ইরফানকে সিনেমায় নিয়ে অভিনয় করিয়েও বাদ দিয়েছিলেন মীরা, সেই ইরফানই ক্রিস্টোফার নোলান, রাইডলি স্কটের মতো নামজাদা ডিরেক্টরদের দেওয়া অফারে অবলীলায় না করে দেন একাধিকবার!
ইন্টারস্টেলার, সাইফাইপ্রেমীদের কাছে এ এক অনুভূতির নাম। তাতে কাজের প্রপোজাল মেলে, কিন্তু লাঞ্চবক্সের জন্য তা ছেড়ে দেন ইরফান। দ্য মার্শিয়ান আরেক ভালো লাগার নাম। রাইডলির দুর্দান্ত নির্মাণ আর ম্যাট ডেমনের অভিনয়ে এটিও সকলের পছন্দের। ইরফান এটাও প্রত্যাখান করেন পিকু’র জন্য! তার আগে রাইডলি স্কটের অ্যাকশন থ্রিলার বডি অব লাইসে নাম লেখাননি চিত্রনাট্য পছন্দ হয়নি বলে! এত না’র পরেও নামের পাশে অ্যামেজিং স্পাইডারম্যান, জুরাসিক ওয়ার্ল্ড, ইনফার্নো দিয়ে হলিউড মাতিয়েছেন। লাইফ অব পাই, স্লামডগ মিলিয়নিয়ার, অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড বাগানো এই একজোড়া চলচ্চিত্রের সাধারণ মিল ইরফান খান আর পর্দায় তার সহজ অথচ দাপুটে অভিনয়। জুরাসিক ওয়ার্ল্ডে অভিনয়ের পর ইরফান খান বলেন- ‘১৯৯৩ সালে জুরাসিক পার্ক মুক্তির পর হলে গিয়ে দেখার টাকা ছিল না। আজ আমি সেই সিরিজের মুভিতে অভিনয় করছি।’
ইরফানের চলচ্চিত্রগুলো দর্শকের কাছাকাছি আসতে পারার অন্যতম কারণ তিনি নিজে। জীবনঘনিষ্ঠ সংলাপে গেঁথে যেতেন দর্শকের মনে। লাইফ অব পাই’য়ে বলেছেন অমূল্য এক সংলাপ- ‘যে জিনিসটি আমাদের সবচাইতে বেশি কষ্ট দেয়, তা হচ্ছে প্রিয়জনকে শেষবার বিদায় বলার সময়টুকু না পাওয়া।’
পিকুতে দেন আরেকটি ডার্ক হিউমারাস সংলাপ– ‘পটি এবং মৃত্যু, যেকোন সময় যেকোন স্থানে আসতে পারে।’ সত্যিই, বৈশাখের টালমাটাল কালবেলায় হুট করেই এসেছে ইরফানের মৃত্যু সংবাদ। হেরে গেছেন ক্যান্সারের কাছে। নিউরোএন্ডোক্রাইন টিউমারের সঙ্গে দু বছর লড়াই করে চলে যান সব মায়া ত্যাগ করে। লাইফ ইন অ্যা মেট্টোয় ইরফান শিখিয়েছেন দুঃখকে কিভাবে উড়াতে হয়। শহরের সবচেয়ে উঁচু দালানের ছাদে উঠে কঙ্কনা সেন শর্মার সঙ্গে সর্বস্ব দিয়ে চিৎকার করা ইরফানের মৃত্যুতে যেন একমূহুর্তের জন্য থমকে গেছে সব।
বলিউড এবং হলিউড সদম্ভে ঘুরে আসা ইরফানের কাছে মনে হয়েছিল, বলিউডের উচিত হয়নি ‘বলিউড’ নামটা রাখা। ব্যাখ্যা করেন এভাবে, ‘ভারতীয় সিনেমার নিজস্ব সংস্কৃতি আছে। শুধু শুধু হলিউডের আদলে নাম রাখার প্রয়োজন ছিল না। দুটো ইন্ডাস্ট্রিই নিজ গুণে স্বয়ংসম্পূর্ণ।’
তিনি বিতর্ক এড়িয়ে চলতেন। যেসব চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যে মনে হতো ধর্মীয় উস্কানি বা সংস্কৃতিতে আঘাত আসতে পারে, তা এড়িয়ে যেতেন। ক্যারিয়ারে ৮০টির মতোন সিনেমা করলেও বিতর্কের মুখে তাই পড়েননি বললেই চলে। তবে একদমই পড়েননি তা নয়! শিয়া ধর্মের উৎসব মহররমের সময় শিয়াদের পশু কুরবানি নিয়ে মন্তব্য করে রোষের মুখে পড়েন ইসলামিক নেতাদের। সেই সময় তার বলা ‘আমরা এসব রীতি পালন করি পেছনের অর্থ না জেনেই’– কথাটা সমালোচনার ঝড় তোলে। নামের কারণে বড়ো বিপাকে পড়তে হয় ইরফাকে। নামের সাথে একজন সন্দেহভাজন হামলাকারীর সাদৃশ্য থাকায় নিউ ইয়র্কে ৯/১১’-র হামলার পর দুইবার তাকে লস অ্যাঞ্জেলস বিমানবন্দরে আটক করা হয়।
শুধু বলিউডে নয়, হলিউডেও নিজেকে প্রমাণের আরও সময় পড়ে ছিল ইরফানের সামনে। কথা ছিল হলিউডে জুটি বাঁধবেন স্টিফেন স্পিলবার্গের সঙ্গে রোবো অ্যাপোকেলিপ্সো, সুজিত সরকারের উধম সিং বায়োপিক প্রজেক্টে। কথা রাখা হয়নি এই যাত্রায়।
সব্যসাচী, সরল, সাবলীল অভিনয়ের শেষ শো আংরেজি মিডিয়ামে তার মুখ থেকে বের হয় এক আপ্তবাক্য- ‘জীবন যখন হাতে লেবু ধরিয়ে দেবে, তা চেপে শরবত বের করো।’ হতাশায় নিমজ্জিত বহু মানুষকে অনুপ্রেরণা দিতে এই একটি সংলাপই যথেষ্ট।
ক্রিকেটের সবুজ ঘাস ছেড়ে অভিনয়ের রঙিন কার্পেটে এসে পরিশ্রমকে ভালেবেছেন ইরফান। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ইরফান বন্দনায় মেতেছে সকলে। এমন শক্তিধর অভিনেতা তো আর অহরহ আসে না। তারা আসেন, জয় করেন। সিনেমার ভেতর দিয়ে উপলব্ধি করতে শেখান ছোটো ছোটো মূহুর্তগুলোকে। তাদের ছোঁয়ায় পূর্ণতা পায় রূপালি ক্যানভাস। তৈরি হয় মোহের, যাতে দর্শক থেকে শুরু করে ডুবতে চান নিন্দুকও। ‘আনান্দ’ সিনেমায় রাজেশ খান্নার বলা একটি কথা মনে পড়ছে ভীষণভাবে। ‘জীবন লম্বা নয়, বড়ো হওয়া উচিত বাবুমশাই।’ ইরফান খান চলে যাবার আগে সুবিশাল এক জীবন রেখে গেছেন। যে জীবনের বন্দনা কখনও শেষ হবার নয়!
——————————————————————————————————————–
Feature Image: Vaibhabi Mishra