লেভানদস্কি সময়ের অন্যতম পরিপূর্ণ স্ট্রাইকারের নাম। তিনি ক্লাব ক্যারিয়ারে সম্ভাব্য সব ট্রফিই জিতেছেন এবং সর্বশেষ দশকে রোনালদো, মেসি’র পরেই সবোর্চ্চ ৪১৭ গোল করেন। পোলিশ এই ফরোয়ার্ডের বর্তমান ঠিকানা জার্মানির বায়ার্ন মিউনিখ ফুটবল ক্লাব।
১৯৮৮ সালের ২১ আগস্ট জন্ম হয় পোল্যান্ড এর ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং সর্বোচ্চ গোলদাতা রবার্ট লেভানদস্কি’র। তার জন্ম একটি বুনিয়াদি ক্যাথলিক পরিবারে, যাদের খেলাধুলাতে প্রচুর আগ্ৰহ আছে। আর ৫টা বাচ্চাদের মতো রবার্ট লেভানদস্কি’র ও ছোটবেলাতে খেলাধুলায় আগ্ৰহ চোখে পড়ে তার বাবার। কিন্তু তার বাবার বিষয়টি ভালো লাগে এবং তিনি লেভানদস্কিকে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি তাকে প্যাট্রিজেন্ট লেসনো নামক স্থানীয় ক্লাবে ট্রেনিং করানোর জন্য নিয়ে যেতে থাকেন। যাত্রা অনেকটা এভাবেই শুরু হয় বর্তমান সময়ের অন্যতম সেরা এই স্ট্রাইকারের।
রবার্ট লেয়ানডোভস্কি জুন ২০১৩ সাল থেকে আন্না লেয়ান্ডোভস্কার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। তিনি ২০০৯ কারাতে বিশ্বকাপে ব্রোঞ্জ পদক অর্জনকারী একজন ক্রীড়াবিদও ছিলেন। তার স্ত্রী ২০১৭ সালে একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছেন; কন্যা সন্তানের নাম ক্লারা লেয়ান্ডোভস্কা ছিল। পরবর্তীতে তাদের ঘরে লাউরা লেয়ান্ডোভস্কা নামে দ্বিতীয় কন্যা সন্তানের জন্ম হয়।
লেভানদস্কির যুব ক্যারিয়ার শুরু করেছিল ৯ বছর বয়সে। সে ভারসোভিয়া ওয়ারসো ইউথ সিস্টেমের সাথে নথিভুক্ত হয় এবং নোংরা , বালুময়, কুয়াশাচ্ছন্নের মতো প্রতিকূল পরিবেশে প্রশিক্ষণ নিতে থাকে। তার বাবার নাম ক্রিসটফ লেভানদস্কি। তারা যখন ডেল্টাতে ছিল তার বাবা স্বপ্ন দেখতো যে রবার্ট লেভানদস্কি একদিন বুন্দেসলিগায় খেলবে। কিন্তু হঠাৎ একদিন তিনি মারা যান এবং আর্থিক অনটনের মাঝে তার বোন মিলেনা লেভানদস্কাকে নিয়ে সেখান থেকে চলে যান রবার্ট লেভানদস্কি।
লেভানদস্কি তার সেরা ফর্মের দরুন তিনি লেজিয়া ওয়ারসো ক্লাব স্কাউটের নজরে পড়েন।সে তার সেরা ফর্ম অব্যাহত রেখেছিল যতক্ষণ পর্যন্ত না সে একটা বাজে ইনজুরির সম্মুখীন হয়। কিন্তু এই ইনজুরির কারণে লেজিয়া ওয়ারসো তার সাথে চুক্তি বাড়ানোর সাহস পায় নি। পরের মৌসুমে সে যোগ দেয় পোল্যান্ডের ৩য় বিভাগ এর ক্লাব জিয়ং পুরসোতে ১৫০০০ ইউরোর বিনিময়ে। সেখানে তিনি দুই মৌসুম খেলেন এবং তিনি ৩য় বিভাগ এর সর্বোচ্চ গোলদাতা হন (১৫ গোল) ২০০৬-২০০৭ মৌসুমে। পরবর্তী ২০০৭-২০০৮ মৌসুমে (২১ গোল) তিনি ২য় বিভাগের সর্বোচ্চ গোলদাতা হন জিয়ং পুরসো’র হয়ে।
পরবর্তীতে ৩৮০ হাজার ইউরোর বিনিময়ে লেচ পোজম্যান এ যোগ দেন। লেচ পোজম্যানে যোগ দেয়ার আগে স্প্যানিশ লিগে সেবারের নতুন উন্নীত ক্লাব স্পোটিং গিয়নের কাছে রিজেক্টেড হন। একস্ট্রাক্লাসে তার প্রথম খেলায়, লেভানদস্কি গোল করেছিলেন এবং দুর্দান্ত ফর্মে অব্যাহত রাখে যা তাকে গোল-স্কোরিং চার্টে দ্বিতীয় স্থানে রেখেছিল। একস্ট্রাক্লাসের দ্বিতীয় মৌসুমে, তিনি গোল স্কোরিংয়ে লিগের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তার এই অসাধারণ পারফরম্যান্স এর দরুন অনেক বড় বড় ক্লাবের নজর কেড়েছিলেন কিন্তু সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে ৪.৭৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে যোগ দেন জার্মান জায়ান্ট বুরুসিয়া ডর্টমুন্ডে।
২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি ডর্টমুন্ডের হয়ে প্রথম গোলটি করেছিলেন। তিনি মৌসুমের মধ্যে আশ্চর্যজনক ফর্ম অবিরত রেখেছিলেন, যা তাকে পোলিশের সেরা বর্ষসেরা খেলোয়াড়ের পুরষ্কার দিয়েছিল। তারপরে তিনি ক্লাবের সাথে বুন্দেসলিগা জিতে যান এবং লিগে তৃতীয় সর্বোচ্চ রানের স্কোরার হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। টুর্নামেন্টের শীর্ষ স্কোরার হিসাবে শেষ করেছিলেন এবংবায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে ডিএফবি-পোকাল ফাইনালেও দু’টি গোল করেছিলেন।ডর্টমুন্ডের সাথে তার দ্বিতীয় মৌসুমে, তিনি তার অসাধারণ ফর্ম চ্যাম্পিয়নস লিগে নিয়ে যান। তিনি উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনালে চারটি গোল করার প্রথম খেলোয়াড় হয়েছিলেন। টুর্নামেন্টের ফাইনালে তার দল বুন্দেসলিগা প্রতিপক্ষ বায়ার্ন মিউনিখের কাছে পরাজিত হয়েছিল। তিনি জার্মান সুপার কাপ জয়ের মাধ্যমে ডর্টমুন্ডের সাথে তৃতীয় এবং শেষ মৌসুম শুরু করেছিলেন। তিনি একটি দুর্দান্ত মৌসুম কাটিয়েছেন, লিগে সবোর্চ্চ গোলদাতা হিসেবে। ২০১৪ সালের জার্মান কাপ ফাইনালটি তার ডর্টমুন্ডের হয়ে সর্বশেষ ম্যাচ।
পরবর্তী মৌসুমে তিনি দল পরিবর্তন করেন যোগ দেন ডর্টমুন্ডেরই প্রতিপক্ষ শিবির বায়ার্ন মিউনিখে। সম্পূর্ণ ফ্রি দলবদলে ৫ বছরের চুক্তিতে যোগ দেন। জার্মান সুপার কাপে বায়ার্ন মিউনিখের হয়ে তিনি প্রতিযোগিতামূলকভাবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনাল ও বুন্দেসলিগার ট্রফি জিতে মিউনিখের সাথে দুর্দান্ত এক অভিষেক মৌসুম পার করেন তিনি। জার্মান সুপার কাপটি হারিয়ে তিনি বায়ার্নের সাথে দ্বিতীয় মৌসুম শুরু করেছিলেন। তিনি মৌসুম জুড়ে শীর্ষ ফর্ম অব্যাহত রাখেন এবং একটি আশ্চর্যজনক বুন্দেসলিগা রেকর্ড স্থাপন করেন।ওল্ফসবার্গের বিপক্ষে সেপ্টেম্বর ২০১৫-এর বুন্দেসলিগা খেলায় তিনি বিকল্প হিসাবে এসেছিলেন এবং ৮ মিনিট ৫৯ সেকেন্ডের মধ্যে, তিনি ৫ গোল করেছিলেন, যা কোনও খেলোয়াড়ের পক্ষে ইউরোপের যে কোনও বড় ফুটবল লিগে 5 গোল করার দ্রুততম সময় ছিল। কীর্তিটি একটি আশ্চর্যজনক যা তাকে চারটি গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস অর্জন করিয়েছিল। তিনি ব্যালন ডি’অর পুরষ্কারে চতুর্থ স্থান অর্জন করেছিলেন এবং বুন্দেসলিগায় স্কোর চার্টে শীর্ষে ছিলেন।
তার তৃতীয় মৌসুমে, বায়ার্ন মিউনিখের সাথে ২০১৬/১৭ মৌসুমে, তিনি বায়ার্ন সুপার কাপ, বুন্দেসলিগা জিতেছিলেন এবং ক্লাবের সাথে একটি চুক্তি সম্প্রসারণও স্বাক্ষর করেছিলেন ২০২১ সাল পর্যন্ত। তিনিও এই সময়ে ১০০ টি গোলে পৌঁছেছিলেন। ২০১৭/১৮ মৌসুমে, তিনি সূক্ষ্ম ফর্মে অবিরত ছিলেন এবং গোটা লিগেও গোলে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। পর পর সপ্তমবারের জন্য তিনি বর্ষসেরা পোলিশ খেলোয়াড় নির্বাচিত হন।
২০১৮/১৯ মৌসুমে, লেওয়ানডোভস্কি তার অগ্নিসংযোগকারী গোল স্কোরিং ফর্মে ফিরে এসে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ৫০ টি গোলে পৌঁছে যাওয়া তৃতীয়তম খেলোয়াড় হয়ে উঠেছিলেন। তিনি বায়ার্ন মিউনিখ সর্বকালের সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতাও হয়েছিলেন। পোলিশ তারকা বুন্দেসলিগায় কোনও বিদেশি খেলোয়াড়ের পক্ষে সর্বাধিক গোলদাতা হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি লিগের শীর্ষস্থানীয় স্কোরার হিসাবে মৌসুম শেষ করেছন, পর পর চতুর্থ মৌসুমে তিনি ৪০ টিরও বেশি গোল করেতে সক্ষম হন। একই মৌসুমে দ্বিতীয়বারের মতো বুন্দেসলিগা এবং ডিএফবি-পোকালও জিতেছিলেন তিনি।
লেভানদস্কির আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে লেভান্দস্কির অভিষেক হয় পোলিশ অনূর্ধ্ব-২১ জাতীয় দলের হয়ে তিনটি ফ্রেন্ডলি ম্যাচে অংশ নেওয়ার মাধ্যমে। পরে তিনি ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে সিনিয়র দলের হয়ে আত্মপ্রকাশ করেন। তারপরে ইউরো ২০১২ তে পোল্যান্ডের হয়ে অংশ নেন। ২০১৪ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে তার দলের নেতৃত্বে ছিলেন যেখানে তারা ব্যর্থ হয়েছিল।
২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে, ২০১৪ ইউরো বাছাইপর্বের প্রথম ম্যাচে, তিনি হ্যাটট্রিক করেছিলেন এবং বাছাইপর্বে মোট ১৩টি গোল করেছিলেন। ইউরো ২০১৬-তে, তিনি তার দলকে কোয়ার্টার ফাইনালে নিয়ে গিয়েছিলেন যেখানে তারা পর্তুগালের কাছে হেরেছিল। ২০১৮ বিশ্বকাপে, তার দল পোল্যান্ড গ্রুপ পর্ব অতিক্রম করতে ব্যার্থ হয়েছিল এবং লেয়ানডোভস্কি কোনও গোল করতে পারে নি সেই টুর্নামেন্টে। বর্তমানে তিনি পোল্যান্ডের ইতিহাসের সবোর্চ্চ গোলদাতা।
৩২ বছর বয়সী এই ফুটবলারের নেট মূল্য ৪৫ মিলিয়ন ইউরো। চলমান সময়ের অন্যতম এই নাম্বার নাইন সর্বশেষ চ্যাম্পিয়নস্ লীগ জিতেন। সেইসাথে ১৯-২০ মৌসুমে ফিফা বেস্ট তকমাটাও তার দখলে।
Reference:
-
Robert Lewandowski Biography; https://www.thefamouspeople.com/profiles/robert-lewandowski-36042.php
-
Robert Lewandowski Childhood; https://lifebogger.com/robert-lewandowski-childhood-story-plus-biography/
-
who is Robert Lewandowski; https://cfwsports.com/robert-lewandowski/
- Feature Image: Marca