, , ,

অনুপ্রেরণা নাকি স্ফুলিঙ্গঃ হেলেন কেলার

অনুপ্রেরণার এক স্ফুলিঙ্গঃ হেলেন কেলার

ছোটবেলায় রূপকথার গল্প শুনতে পছন্দ করতো না এমন কাউকে কি আতশি কাঁচ দিয়েও খুঁজে পাওয়া যাবে? রূপকথার গল্প যেন আগ্রহের এক খোরাকের নাম; হোক সে শিশু, হোক সে কিশোর কিংবা যুবক। এমনকি বার্ধক্যে উপনীত আদম সন্তানরাও অনেক সময় রূপকথার গল্প শুনে টান উত্তেজনা কিংবা হাড্ডাহাড্ডি আড্ডার মাঝে। প্রায় সব বয়সের মানুষেরই আছে গল্প শোনার এক সহজাত কৌতূহল। উত্তেজনার পারদের উঠানামা  কিংবা রোমাঞ্চকর অনুভুতির সংমিশ্রণ নিয়ে গল্পের কথকের দিকে আমরা কমবেশি সবাই চেয়ে থাকি, গল্পের শেষটা না জানি কীভাবে হয় ! সেই সাথে মনের মধ্যে এমন প্রশ্ন তো উঁকি দিতেই পারে, “রূপকথা কি বাস্তবেও সম্ভব?” এমনই এক রূপকথার রাজ্য থেকে আজ আপনাদের নিয়ে ঘুরে আসি । চলুন, তাহলে আর দেরি কেন?

                              রূপকথার রাজ্যে হারিয়ে যেতে কার না ইচ্ছে করে ? [ ছবি সূত্রঃ indianfolk.com ]

রূপকথার এই রাজকন্যা এমন এক ব্যক্তি যিনি মাত্র দেড় বছর বয়সে শ্রবণ,বাক এবং দৃষ্টি প্রতিবন্ধীত্বের মুখোমুখি হয়েছিলেন; অথচ তাঁকেই কি না বিশ্ববিখ্যাত মার্কিন লেখক মার্ক টোয়েন আখ্যায়িত করেছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দুই জন ব্যক্তিত্বের একজন হিসেবে। জীবনের নির্মম রূপ দেখা এই মহীয়সী নারী চেষ্টা আর পরিশ্রমের দ্বারা এক সময় কথা বলতে সক্ষম হয়েছিলেন। গল্প কি এখানেই শেষ ? আপনাকে তাহলে একটু চমকে দেয়া যাক। আমি যদি এখন বলে বসি, বাক-প্রতিবন্ধীত্বের নির্মম আঘাত সত্ত্বেও পরবর্তী জীবনে এই কিংবদন্তি বক্তৃতা দিয়ে ফিরেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সবগুলো অঙ্গরাজ্যে ! শুনতে অবাক হলেও সত্যি সত্যিই মনের জোর আর কর্মোদ্যমের মাধ্যমে তিনি স্থাপন করেছিলেন অনন্য এক দৃষ্টান্ত।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলবামা অঙ্গরাজ্যের তাসকামবিয়া শহরে ১৮৮০সালের ২৭শে জুন আর্থার হেনলি কেলার এবং কেট অ্যাডামস কেলারের ঘর আলো করে এক শিশুর জন্ম হয়। মা বাবা আদর করে নাম রাখেন হেলেন। পুরো নাম হেলেন অ্যাডামস কেলার।

 শিশু হেলেন ; ছবি সূত্রঃ Pinterest

জন্মের পর বছর দেড়েক আর দশটা শিশুর মতোই হেলেন দেখতে পেতেন, কানে শুনতেন এবং কথাও বলতে পারতেন মুখ ফুটে।প্রতিবন্ধীত্বের করাল গ্রাসে হেলেনের ছেলেবেলা হয়ে ওঠে রীতিমত দুর্বিষহ। দুঃখ ভরাক্রান্ত শিশুটির যা-ই খারাপ লাগতো, রাগে ক্ষোভে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতো ভেঙ্গে চুরমার করে । স্বাভাবিকভাবেই মেয়ের এই আচরণ বাবা-মায়ের মনে তীব্র বিষাদের ছাপ ফেলে। এমনই এক সময় হেলেনের মা ক্যাথেরিন প্রখ্যাত ব্রিটিশ সাহিত্যিক চার্লস ডিকেন্সের ‘আমেরিকান নোটস’ পড়তে গিয়ে বোস্টন শহরে অবস্থিত পারকিন্স ইন্সটিটিউটের সন্ধান পান।  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের বোস্টনে অবস্থিত পারকিন্স ইন্সটিটিউট এমন একটি প্রতিষ্ঠান যা মূক,বধির এবং দৃষ্টি প্রতিবন্ধিদের চিকিৎসা করে থাকে। প্রতিষ্ঠান না বলে একে হাসপাতাল বলাই শ্রেয় যেখানে গিয়ে শিশু হেলেনের পরিচয় হয় এমন এক মানুষের সঙ্গে যার বদৌলতে ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে তাঁর ভবিষ্যৎ জীবন। আর এই মানুষটির নাম জোহানা ম্যানসফিল্ড সুলিভান ম্যাসি।তবে তিনি অ্যান সুলিভান নামেই বেশি পরিচিত। তাঁর তত্ত্বাবধানে পরম যত্ন এবং মায়ায় চলতে থাকে হেলেনের চিকিৎসা। সবাইকে অবাক করে দিয়ে মাত্র এক বছরের মাথায় শিশু হেলেন কথা বলতে শেখেন। ব্রেইল পদ্ধতিতে হেলেন একে একে আয়ত্ত করেন ইংরেজি, লাতিন, গ্রিক, ফ্রেঞ্চ এবং জার্মান ভাষা। জীবনের এক দশক পেরিয়ে যদি কেউ প্রথমবারের মত কথা বলতে পারে, তবে তার অনুভূতি কেমন হতে পারে? কেমন হতে পারে ১৮৯০সালের ২৬শে মার্চ দিনটি, অন্তত হেলেনের জীবনে? কারো সাহায্য ছাড়াই হেলেন অ্যাডামস কেলার এ দিন কথা বলে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। বাকশক্তিসম্পন্ন হেলেনের প্রাথমিক জীবনে উচ্চারিত একটি বাক্য চারদিকে বেশ আলোড়ন ফেলে।“I am not dumb now” বা “ আমি এখন আর বোবা নই” বাক্যটি অনুপ্রেরণার স্ফুলিঙ্গের মত ছড়িয়ে পড়ে দেশে দেশে।অপ্রতিরোধ্য হেলেনের এগিয়ে চলার গল্প থেমে থাকে নি। ১৯০০ সালে তিনি ভর্তি হন র‍্যাডক্লিফ কলেজে।

রেডক্লিফ কলেজের শিক্ষার্থী থাকাকালীন হেলেন; ছবিসূত্রঃ Getty Images

কিংবদন্তি হেলেনের কিংবদন্তিময় পদচারণার স্বাক্ষর বয়ে চলেছে জীবনভর। ব্যাচেলর অব আর্টস পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়ে তিনি উত্তীর্ণ হন। এমনকি দৃষ্টি এবং শ্রবণশক্তিসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের চেয়েও তিনি বেশি নাম্বার পেয়েছিলেন। মাইলফলকের পর মাইলফলক-ই অর্জন করে গিয়েছেন জীবনজুড়ে। ‘অপটিমিজম’(Optimism), ‘দ্যা স্টোরি অব মাই লাইফ’(The Story of My Life), ‘দ্যা ওয়ার্ল্ড আই লিভ ইন’ (The World I live in) কিংবা ‘দ্যা সং অব দ্যা স্টোন ওয়াল’(The Song of the Stone Wall) বইয়ে তিনি বলে গিয়েছেন নিজের জীবনের কথা, নিজের জগতের কথা, নিজের না বলা কথা। ব্রেইল পদ্ধতিতে লেখা তাঁর বইগুলো স্বাভাবিক হরফে রুপান্তর করে প্রকাশ করা হতো। অন্ধ ও বধির লেখিকার অন্ধকার জগতের অসাধারণ বাস্তব কথাগুলো ছাপ ফেলতে শুরু করে পাঠকের হৃদয়ে। কিংবদন্তি হেলেন অ্যাডামস কেলারের জনপ্রিয়তাও ছিল কিংবদন্তির মতোই। সময়ের সাথে সাথে তাঁর এই জনপ্রিয়তা আকাশ ছুঁতে দেরি করে নি। হেলেনের জীবনে আরেক মমতাময়ী নারী ছিলেন স্কটিশ মহিলা পলি থমসন। পারিবারিক এবং অসুস্থতাজনিত কারণে অ্যান সুলিভান যখন হেলেনকে সান্নিধ্য দিতে পারছিলেন না, তখন এই একান্ত সহকারিণীকে হেলেনের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।

ছবিতে মাঝে হেলেন কেলার, বামে অ্যান সুলিভান(কালো ড্রেস পরিহিত)  এবং ডানে পলি থমসন ;

  ছবি সূত্রঃdigitalcommonwealth.org

চলতে থাকে হেলেনের জীবন আর ঘটতে থাকে নানা চমকপ্রদ ঘটনা।১৯১৮ সালে হেলেন কেলারের জীবনীর উপর একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রস্তাব আসে খোদ হলিউড থেকে। এখানেই শেষ নয়। ‘ডেলিভারেন্স’(Deliverance) নামের চলচ্চিত্রে হেলেন অ্যাডামস কেলার নিজেই অন্ধ ও বধির নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করে তাক লাগিয়ে দেন পুরো বিশ্বকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হতাহত মানুষকে অনুপ্রেরণা যোগাতে হেলেন ছুটে যান তাদের দুয়ারে দুয়ারে। অনেক অন্ধ সৈনিকদের এ সময় তিনি প্রশিক্ষণও দেন।তাঁর বক্তৃতা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতো হতাহত সৈন্যসহ আশেপাশের মানুষজন। র‍্যাডক্লিফ কলেজে পড়াকালীন তাঁর লেখা বই ‘অপটিমিজম’ (Optimism) প্রকাশের পর থেকেই অবশ্য তাঁর বক্তৃতা শোনার জন্য মানুষের আগ্রহ বাড়তে থাকে। একের পর এক আসতে থাকে বক্তৃতা দেবার জন্য আমন্ত্রণও। বই কিংবা বক্তৃতায় বলা তাঁর কথাগুলো মানুষকে এক অন্য জগতের সন্ধান দিতো, জাগাতো এক অজানা অনুভূতি। হেলেনের বলা তাঁর জীবনের অন্ধকার রাজ্যের কথাও ভীষণভাবে আকৃষ্ট করতো শ্রোতাদের। দেশ থেকে দেশ দেশান্তরে তিনি বক্তৃতা দিয়ে বেড়িয়েছেন, তাঁর ভাষণ শুনেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের মানুষেরা।এই মহীয়সী নারী ভ্রমণ করেছেন ইউরোপের প্রায় সবগুলো দেশ। সান্নিধ্য পেয়েছেন তৎকালীন (২৮তম) প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন, বিখ্যাত শিল্পপতি,লেখক ও ব্যক্তিত্ব এন্ড্রু কার্নেগী, প্রখ্যাত ইংরেজ অভিনেতা স্যার হেনরি আরভিং,দুনিয়া কাঁপানো মার্কিন সাহিত্যিক মার্ক টোয়েনসহ আরও অনেকের।

প্রখ্যাত মার্কিন সাহিত্যিক মার্ক টোয়েনের সাথে কিংবদন্তি হেলেন কেলার; ছবি সূত্রঃ Walter Sanders ( via Getty Images )

শুনলে অবাক হতে হয়, দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন অনেক জ্ঞানীলোকের চাইতেও হেলেন বেশি বই পড়েছেন। আর একজন সাধারণ মানুষের তুলনায় তিনি বই পড়েছেন প্রায় শতগুণ বেশি। জীবনের বাঁকে বাঁকে জয়গান গাওয়া এই মহীয়সী নারী ১৯৬৮সালের ১লা জুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কানেক্টিকাটের ইস্টনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি আর মনের জোর যে মানুষকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে তার এক জ্বলজ্যান্ত উদাহারণ হিসেবে হেলেন অ্যাডামস কেলার ইতিহাসে অক্ষয় হয়ে থাকবেন।শেষ করছি জগদ্বিখ্যাত মার্কিন সাহিত্যিক স্যামুয়েল ল্যাংহর্ন ক্লিমেন্সের একটি উক্তি দিয়ে যাকে পুরো দুনিয়া চিনে মার্ক টোয়েন নামে।

“ঊনবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দুটো চরিত্র হলো সম্রাট নেপোলিয়ন এবং হেলেন কেলার।“

শেষ হয়েও হলো না শেষ। হেলেন অ্যাডামস কেলারের নিজের বলা একটি কথা না হয় বলেই ফেলি

“পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জিনিসগুলো আমরা হয়তো ধরতে পারি না, ছুঁতেও পারি না; কিন্তু হৃদয় দিয়ে ঠিকই অনুভব করতে পারি।“

ফিচার ইমেজঃ Getty Images

তথ্যসূত্রঃ

https://www.britannica.com/biography/Helen-Keller

https://www.biography.com/activist/helen-keller

https://www.biography.com/activist/anne-sullivan

https://www.history.com/topics/womens-rights/helen-keller

Related Articles

অন্যান্য
Sirajul Islam Mozumder

পিকি ব্লাইন্ডার্সঃ বিংশ শতাব্দীতে বার্মিংহামের রাস্তা দাপিয়ে বেড়ানো এক দস্যুদল

“বাই দি অর্ডার অব পিকি ব্লাইন্ডার্স”। আপনি যদি সিরিজপ্রেমী হয়ে থাকেন, তবে এই বাক্যটির সাথে

বিস্তারিত »
সোশ্যাল মিডিয়া
পাঠক প্রিয়
খেলা
ফেইসবুক পেজ