“ভ্যাম্পায়ার” শব্দটার অর্থ না জানলেও আমরা জানি এটি কী জিনিস। তবুও যারা জানেন না তাদেরকে একটা ধারণা দেই, ভ্যাম্পায়ার শব্দের অর্থ “রক্তচোষা” বা “বাদুড়” অথবা “রক্তচোষা বাদুড়”। প্রাচীন বুক অফ জেনেসিসে এই ভ্যাম্পায়ার নিয়ে অনেক কাহিনী বর্ণিত আছে। আর রুমানিয়া, ট্রান্সিলভিনিয়ায় তো রীতিমতো গা ছমছমে মিথ প্রচলিত আছে এই ভ্যাম্পায়ার নিয়ে। সেখানে কথিত আছে ভ্যাম্পায়ার শয়তানের আরেক রূপ, তারা রাতের আঁধারে বেরোয়, এবং শিকারের সন্ধান করে। এটি নিয়ে আধুনিক সময় গুলোতেও লেখা হয়েছে সাহিত্য, সিনেমা, গল্প, মঞ্চ নাটক ইত্যাদি। ফলে ভ্যাম্পায়ার নিয়ে আমাদের সবারই মোটামুটি এক ধরণের ফ্যান্টাসি কাজ করে। বিশেষ করে যারা বই, মুভি-তে ভ্যাম্পায়ার এর জীবনযাপন, অসীম ক্ষমতা, দীর্ঘজীবন দেখে থাকে। তারা অনেকেই ভ্যাম্পায়ার হতে চান, রাতের অন্ধকারে কালো পোষাক পরে, নিশাচর প্রাণীর মতো শিকারের খোঁজে বেরিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে চান জনমনে। টিনেজ ছেলেমেয়েদেরই এই ব্যাপার গুলোতে আগ্রহী হতে দেখা যায়। এদের কেউ কেউ এই কল্পনার জগতে থেকে নিজেকে বের করতে না পেরে বাস্তবেই ভ্যাম্পায়ার এর মতো জীবন-যাপন শুরু করে দেয়। এই পর্যন্ত তো ঠিকই আছে, কিন্তু কখনো কী শুনেছেন, এই ভ্যাম্পায়ার ফ্যান্টাসি কোন মানুষকে একের পর এক খুন, রক্তপান করার প্রতি প্ররোচিত করতে পারে?
বলছিলাম আর্জেন্টিনার মন্টেরোজে জন্ম নেয়া একজন তরুণের কথা। নাম তার ফ্লোরেন্সিও রক ফার্নান্দেজ। মাত্র আঠারো বছর বয়সী এই তরুণ এখনো “আর্জেন্টাইন ভ্যাম্পায়ার” বা “দ্য উইন্ডো ভ্যাম্পায়ার” হিসেবে পরিচিত পৃথিবীর কাছে। তার জন্ম হয়েছিলো ১৯৩৫ সালে। বেশ গরীব পরিবারে জন্মগ্রহন করা এই ব্যক্তি প্রথম থেকেই মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন।
ফার্নান্দেজের পরিবার নিম্ন আয়ের হওয়ায় তার চিকিৎসা করানোটা তাদের জন্য প্রায় অসম্ভব ছিলো বলা যায়। আর তাছাড়া তখনকার সময়ের চিকিৎসা ব্যবস্থাও এখনকার মত উন্নত ছিলো না। উন্নত চিকিৎসা যতসামান্য ছিল তাও ছিল অনেক ব্যয়বহুল। এই ধরনের উচ্চচিকিৎসা প্রদান সম্ভব ছিলোনা। তাই, স্বল্প খরচে তারা ফার্নান্দেজকে ডাক্তার দেখালেন। চিকিৎসায় ধরা পড়ে তার ফটোফোবিয়া নামক এক চর্মরোগ রয়েছে। যা হলে একজন মানুষ সূর্যের আলো সহ্য করতে পারতো না, তাদের চামড়া এই আলোতেই পুড়তে শুরু করতো। এছাড়াও সেই ডাক্তার জানিয়ে দেন যে তাদের ছেলের মানসিক রোগও আছে। ফার্নান্দেজ ছোট বেলা থেকেই হ্যালুসিনেশনে ভুগতো। চিকিৎসার অভাবে সে আক্রান্ত হয়ে পড়ে পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারের মত রোগে। যখন তার পরিবার এই ডাক্তারের শরণাপন্ন হলেন তখন তার আরও একটি মানসিক রোগ গুরুতর পর্যায়ে চলে গিয়েছিলো। আর সেটা হলো স্কিৎজোফ্রেনিয়া। এবং এটি সারাতে হলে একাধারে উন্নত চিকিৎসা ও কাউনসিলিং প্রয়োজন হয় নিয়মিত। আর সবচেয়ে বেশি যেটা দরকার সেটা হলো মানসিক সাপোর্ট, যা পাওয়া সম্ভব কেবল পরিবার, আত্মীয়স্বজন, ও কাছের বন্ধুবান্ধব থেকে। কিন্তু ফার্নান্দেজের ভাগ্য এত বেশি ভালো ছিল না। যখন তার পরিবার জানলো তাদের ছেলে পাগল, তখন তাদের কাছে ছেলেকে মানসিকভাবে সাপোর্ট দেয়ার চেয়ে বোঝাই বেশি মনে হয়েছিলো। ফলাফল ছেলেকে আর নিজেদের কাছে রাখেন নি।
ফার্নান্দেজকে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে হয় খুবই কম বয়সে। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, আর বেচে থাকার তাগিদ তাকে বাধ্য করে ভিক্ষা করতে। মানুষের কাছে হাত পেতেও যখন ক্ষুদ্রতর জৈবিক চাহিদা পূরণ করা যাচ্ছিলো না তখন সে বেছে নেয় অন্যায়ের পথ। শুরু করে চুরির মত অপরাধ। কিন্তু চুরির ফলে তার চাহিদা আর লোভ হয়তো কিছুটা বেড়েই গিয়েছিলো। ফলে চুরির পাশাপাশি চাহিদা মেটাতে আশ্রয় নেয় ছিনতাই ও ডাকাতির মত পথ। বেশিরভাগ সময় পথচারীদের উপর আক্রমণাত্মক আচরণ করে তাদের অর্থ কেড়ে নিত সে। আর এভাবেই অনেকসময় সেক্সুয়াল এসল্টও করে বসতো।
ফার্নান্দেজ কিশোর বয়সটা এভাবেই কাটিয়ে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলো। তখন একদিন তাদেরই এলাকার থিয়েটারে প্রচারিত হয় আইরিশ লেখক ব্রাম স্টোকারের বিখ্যাত “ড্রাকুলা” উপন্যাসের আলোকে নির্মিত মুভিটি। এটাই হতে দাঁড়ায় আগুনে ঘি ঢালার মত একটা ব্যাপার। মুভিটা দেখে ফার্নান্দেজ এতোটাই অনুপ্রাণিত হয় যে, একসময় নিজেকে সেই ভ্যাম্পায়ার ড্রাকুলা ভাবতে শুরু করে। নিজের স্কিৎজোফ্রেনিক মনে গভীরভাবে দাগ কাটে এই চরিত্রটি। ফলে তার তীব্র ইচ্ছা হয়, সেও ড্রাকুলার মত রাতের আঁধারে মানুষের রক্তপান করবে। তাদেরকেও নিজের মত অমর করে তুলবে। ড্রাকুলা মুভিতে দেখানো হয় কেন্দ্রীয় ভ্যাম্পায়ার চরিত্রের সাথে রয়েছে তিনজন নারী ভ্যাম্পায়ার চরিত্র। এতেই ফার্নান্দেজের ইচ্ছা হয় সেও নারীদের শিকার করবে।
কিন্তু কাল্পনিক গল্পের মত তো ফার্নান্দেজ কোন সত্যিকারের ভ্যাম্পায়ার নয়, আর তার শিকার গুলোকেও সে এমব্রাশ করতে পারবে না। ফলে এমব্রাশ করতে গিয়ে তার হাতে খুন হতে শুরু করে একের পর এক নারী। তার খুনের পদ্ধতিটি ছিলো শিউরে ওঠার মতো। “ড্রাকুলা” মুভির কাউন্ট ড্রাকুলা-কে দেখে অনুপ্রাণিত ফার্নান্দেজ পাহাড়ে এক অন্ধকার গর্ত অথবা গুহায় বসবাস করতো। যেখানে দিনের আলোয় কোনোভাবেই প্রবেশ করতোনা। সারা দিন গর্তে ঘুমিয়ে রাতে গায়ে কালো আলখাল্লা চাপিয়ে বের হয়ে যেতো শিকারে। প্রথম খুনের বর্ণনায় ফার্নান্দেজ জানায় তার ভয়াবহতার কথা। টার্গেট বেছে নিয়ে তাকে অনুসরণ করা, তার উপরে নজর রাখা, পাশাপাশি নিশ্চিত করে নেয়া যে শিকার তার ঘরে একা আছে নাকি। এরপর ঠান্ডা মাথায় সুযোগের অপেক্ষায় থাকা। সুযোগ পাওয়া মাত্রই খুন করা ছিলো তার খুনের নীলনকশা।
তীব্র গরমকাল বা গ্রীষ্মের গরম আবহাওয়াময় রাতে আমরা সকলেই প্রায় ঘরের জানালা খুলে রেখে ঘুমাই। আর ফার্নান্দেজের জন্য এটাই ছিলো সুবর্ণ সুযোগ। যখন শিকার তার ঘরের জানালা খুলে রাখতো তখনই সুযোগটা নিতো সে। ফার্নান্দেজ প্রথম খুন করে তখন তার বয়স মাত্র আঠারো বছর। ঘরের জানালায় জানালায় উঁকি দিয়ে খুঁজছিলো একা বসবাসকারী মেয়ে অথবা মহিলা। হঠাৎ করেই তখন চোখে পড়ে তার প্রথম শিকারকে। সে তখন একাকী তার ঘরে বসে রাতের খাবার খাচ্ছিলো। রাতের খাবার শেষে সে যখন ঘুমোতে আসে ঠিক তখনই জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকে ঘুমন্ত ভিক্টিমকে প্রথমেই হাতুড়ি দিয়ে বেধড়ক মারধর শুরু করে। এরপর কণ্ঠনালি বরাবর কামড়ে ধরেছিলো ফার্নান্দেজ। যেটাকে সে তার ভাষায় রক্তপান বলে অভিহিত করেছিলো।
গ্রেফতারের পর স্বীকারোক্তির সময় ফার্নান্দেজ জানায়, যখন ভিক্টিমের ঘাড়ে বা গলায় কামড়ে রক্ত বের করে দিত, তখন সেটা দেখে তার যৌন উত্তেজনা বেড়ে যেত। অর্থাৎ রক্তের ওপর তার যৌনাকাঙ্ক্ষা ছিলো প্রবল। এরপর ভিক্টিমকে সেভাবেই ফেলে রেখে দিয়েছিলো, যতোক্ষণ না রক্তক্ষরণের কারণে ভিক্টিম মারা যায়। পরবর্তী খুনগুলোর সময় কখনো কখনো ভিক্টিমের ট্রাকিয়া অর্থাৎ শ্বাসনালী আর ক্যারোটিড গ্রন্থি ছিঁড়ে রক্ত বের করে ফেলতো। যদিও বেশিরভাগ সময় প্রথম অবস্থাতেই ভিক্টিম মারা যেতো। তবে, কোনো ভিক্টিমের সাথেই যৌন সম্পর্কে যায়নি সে। যার কারণে তাকে খুঁজে পেতে ভালোই বেগ পেতে হয়েছিলো পুলিশকে।
প্রথম খুনের পর থেকে নিজেকে পুরোদমে ভ্যাম্পায়ার ভাবা শুরু করেছিলো ফার্নান্দেজ। প্রথম খুনের ঠিক একমাস পরেই একইভাবে দ্বিতীয় খুন করে। পরের সাত বছরে মোট তেরটি খুন করে। উল্লেখ্য, খুনের ক্ষেত্রে ভিক্টিমদের বয়স, সামাজিক অবস্থা, গোত্র কোনোকিছুই সে গুরুত্ব দেয়নি। সে শুধু এক রকম আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিলো পুরো এলাকায়।
লোকাল পুলিশ থেকে শুরু করে ডিটেকটিভ পর্যন্ত কেউই ধরতে পারছিলোনা খুনি কে বা খুনের কারণ কী সেটাও জানতো না কেউ। তখনকার সময়ে তার এই খুন নিয়ে এতোটাই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিলো যে এলাকার মানুষ ধরে নিয়েছিলো এর পেছনে কোনো আধ্যাত্মিক শক্তি কাজ করছে। কোনো কূলকিনারা করতে না পেরে অবশেষে এই কেস তুলে দেয়া হয় আর্জেন্টিনার ফেডারেল পুলিশের হাতে৷
ততোদিনে ফার্নান্দেজের নাম ছড়িয়ে গিয়েছে পুরো আর্জেন্টিনায়। ফ্যান্টাসি বা কোন কল্পকাহিনিতে নয় বরং বাস্তবেই এমন কেউ একের পর এক হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে এটা নিয়ে পত্র পত্রিকায় প্রকাশ হচ্ছিলো একের পর এক খবর৷ রাত হলেই ঘরে ঘরে প্রার্থনা চলতো। সবার মাঝে এক ধরনের ভয় এসে গিয়েছিলো যে সত্যিকারের ভ্যাম্পায়রই রাতে জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকে আক্রমণ করছে। তাই বেশিরভাগই জানালা বন্ধ করে রাখতো। তারপরেও রহস্যময় মৃত্যু বন্ধ হচ্ছিলোনা দেখে ভ্যাম্পায়ার বিতাড়িত করার জন্য “হলি ওয়াটার”, “গার্লিক”, “আগুন” ইত্যাদি সবসময় নিজেদের কাছে রাখতো। তবুও থেমে থাকেনি বিভৎস রহস্যময় মৃত্যু গুলো।
ফার্নান্দেজকে খুঁজে পেতে ভালো বেগ পোহাতে হয় আর্জেন্টিনার ফেডারেল পুলিশ অফিসারদের। তদন্তে তাদের চোখে পড়ে খুনের প্যাটার্ন। পনেরোটা কেসের প্রতিটাতে একইভাবে মৃত্যু দেখে সন্দেহ হয় তাদের। খুনি একজনই হবে ধারণা করে কড়া পাহারা বসায় মন্টেরোজের রাস্তায়। গোপন পাহারার ব্যবস্থাও চলে, আর সফল হয় তখনই।
ফার্নান্দেজকে গ্রেফতার করা হয় ১৪ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৬০ সালে। যখন তার বয়স মাত্র পঁচিশ বছর। বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে নিজের ষোলোতম শিকারের ঘরে জানালা দিয়ে ঘরে প্রবেশের সময়, ভিক্টিমের চিৎকারে পালিয়ে যায় সে। পালিয়ে যাওয়ার সময় গোপনে অনুসরণ করা হয় তাকে। এরপরদিন সকালেই তাকে অনুসরণকারী পুলিশের হাতে ধরা পড়তে হয়। আশ্চর্যজনকভাবে গ্রেফতারের সময়ে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেনি ফার্নান্দেজ। যতোক্ষণ না পর্যন্ত পুলিশ তাকে গর্ত থেকে টেনে বের করার পর দিনের আলো তার গায়ে পড়েছিলো, আর তার চামড়া জ্বলে যাচ্ছিল।
ফার্নান্দেজকে “বদ্ধ উন্মাদ” আখ্যা দিয়ে মনোরোগ নিয়াময় কেন্দ্রে পাঠানো হয়। যেখানে কয়েক বছর পরই ১৯৬৮ সালে মাত্র তেত্রিশ বছর বয়সে মৃত্যু ঘটে ফ্লোরেন্সিও ফার্নান্দেজের। এটিকে স্বাভাবিক মৃত্যু হিসেবে ঘোষণা করা হয়। যদিও তার ডেথ সার্টিফিকেটে এ বিষয়ে কোনো উল্লেখ করা হয়নি। এবং এ বিষয়ে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
ফ্লোরেন্সিও ফার্নান্দেজের সিরিয়াল কিলিং এখন পর্যন্ত আর্জেন্টিনার একটি মিথ হিসেবে মানুষের কাছে পরিচিত।
একটা মানসিক রোগের যথাযথ চিকিৎসা না হওয়ার ফলে যে কতবড় বিপদ আসতে পারে এই ঘটনা এর বাস্তব প্রমাণ বলা চলে। আমাদের চারপাশে অসংখ্য ফার্নান্দেজ রয়েছে যাদের আমরা পাগল বলে রাস্তাঘাটে দেখতে পাই। মানসিক বিকৃতি একটা রোগ। এবং এটি সারানো তাদের পরিবারের দায়িত্ব, সেই দায়িত্ব অবহেলার কারণেই তৈরি হয় উন্মাদ ভিখারি, চোর, ডাকাত, বা ছিনতাইকারী। এবং কখনো কখনো ফার্নান্দেজের মত সিরিয়াল কিলার। এখন যুগ পাল্টেছে যদিও। কিন্তু আমাদের সমাজে আমরা আজো মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষকে বোঝা ভেবে দূরে ঠেলে দেই। এখনো পথেঘাটে পড়ে থাকতে দেখি উন্মাদ ভিখারিদের। কিন্তু আমাদের মায়া হয় না৷ কিন্তু যখন তারা ফার্নান্দেজ হয়ে ওঠে, তখন আমাদের মনে জেগে ওঠে ঘৃণা। সত্যিই বড্ডো অদ্ভুত আমরা সুস্থ মানুষ গুলো।
Featured image: BFI
References: