জীবন কখনো কখনো সিনেমার গল্পকেও হার মানায়, তাই না ? ভিন্নধর্মী গল্পে সিনেমা কখনো ছুঁয়ে যায় জীবনকে, স্পর্শ করে যায় জীবনের আঁকে বাঁকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কেচ্ছা কাহিনীকে । আর জীবন ? জীবন সে তো এক জলজ্যান্ত মহাকাব্যিক উপন্যাস। বইয়ের পাতা মানুষকে যা শিক্ষা দেয়, জীবনের পাতা তার থেকে অনেক বেশি কিছু শিখিয়ে দিয়ে যায়। কখনো বা উচ্চবাচ্যে , কখনো আবার নীরবতায়।
ভয়ংকর সুন্দর রকমের নীরবতায় জ্বর-জ্বর শরীর নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে শুয়ে আছি। অন্যমনস্ক চোখে অ্যাম্বুলেন্সের ছাদ দেখছি। জ্বরের মাত্রা অত বেশি না। শৈশবে হওয়া কালাজ্বরের কথা হটাৎ মনে পড়ে গেল। আমার মমতাময়ী মা সারা রাত মলম পট্টি দিতেন। একদিন গাঁয়ের ডাক্তার এসে বললেন, আমি বোধ হয় আর বেশিদিন বাঁচবো না। মায়ের সে কি কান্না ! কান্না জড়ানো কণ্ঠেই আল্লাহর দরবারে দোয়ার পর দোয়া করে গেলেন। সেই জ্বরের কাছে এই জ্বর নিতান্তই নস্যি । চোখের কৌতূহল আমার দৃষ্টি এদিক সেদিক নিয়ে যাচ্ছে । আমার ছেলের চোখেমুখে আতঙ্ক! হাসপাতালে ছুটোছুটি করে ইতোমধ্যেই ক্লান্ত সে । বহু মানুষ লাইনে হাসপাতালে অপেক্ষারত । বাঁচার আকুতিতে কেউ অক্সিজেন সিলিন্ডার চাচ্ছে , কেউ বা আইসিইউতে একটি সিটের জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করে যাচ্ছে। হাসপাতাল এক অদ্ভুত জায়গাই বটে; যেন জীবনের,জানের,প্রাণের হাটবাজার ! বিকিকিনি চলে আত্মার ! মানুষকে যদি এই ক্ষমতা দেওয়া হত তবে একেকটা আত্মার দাম কত হতো?
কী যেন শুয়ে শুয়ে ভাবছি, পাশে বসা আমার স্ত্রীর দিকেও তাকাচ্ছি। আমি এই ৩০ বছরে এমন কী করেছি তাঁর জন্য যে সে আজ আমার পাশে বসে আছে যখন কেউ আমার কাছেও আসছেনা।তাদের ভয় আমার শরীরের রোগ যদি তাদের মৃত্যু ডেকে আনে! আমার মৃত্যুর ভয় নেই। কিন্তু এই স্ট্রেচারে এই বদ্ধ এম্বুলেন্সে শুয়ে আমার খুব মনে পড়ছে ছোটবেলার কথা। বিশাল মাঠ-ঘাট আর শস্যক্ষেতের মেলা । রোগী হিসেবে আমার শরীরে বেশি সমস্যা নেই; তবে শ্বাস প্রশ্বাসের সময় ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। বুকের মধ্যে কেমন যেন একটা ভারী চাপ । দীর্ঘশ্বাসেরা আসতে চেয়েও মনে হয় পারছে না, আটকে যাচ্ছে এই যান্ত্রিকতার বেড়াজালে। আমার মুখে এঁটে দেয়া মাস্কে অক্সিজেন প্রবাহিত হচ্ছে সিলিন্ডার থেকে, সেই সিলিন্ডারের অক্সিজেনও নাকি শেষ হয়ে যাচ্ছে! এ কারণেই কি আমার ছেলের এত দৌড়াদৌড়ি ? যদি একটা সিলিন্ডার পাওয়া যায় ! অন্তত একটা রেমডিসিভির* ইঞ্জেকশন হলেও তো চলে! কিংবা হাসপাতালে আইসিইউ তে একটা বেড !ডাক্তার বলেছে কেউ যদি মারা যায় তাহলে আমাকে সিট দেওয়া হবে। কতটা নিরুপায় একটা সময় ! আমাকে বাঁচাতে অন্যের মৃত্যু কামনা করতে হবে !! শুয়ে শুয়ে এখনো ভাবছি । ছোটবেলায় পুকুরে কে কতক্ষণ শ্বাস আটকে ডুব দিয়ে থাকতে পারে তা নিয়ে প্রতিযোগিতা হতো আমাদের মাঝে।কখনো হারিনি। সেই আমি আজ এই সিলিন্ডারের লিটারে হিসাবকৃত অক্সিজেনের কাছে হারতে বসেছি ? ছটফট করছি আরও একটুখানি অক্সিজেনের জন্য ! জীবন !! এ কোন জায়গায় এসে অপেক্ষমান !!!
পরিশিষ্টঃ
*রেমডিসিভির হলো ব্রড-স্পেকট্রাম বা বিস্তৃত পরিসরের ভাইরাস প্রতিরোধী ঔষধ যা “গিলিড সাইন্সেস” নামক একটি বায়ো-ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির মাধ্যমে চিকিৎসা তালিকায় যুক্ত হয়েছে । এটি মূলত শিরার মাধ্যমে দেহে অনুপ্রবেশ করানো হয় যা ভাইরাস সম্পর্কিত রোগে ব্যবহার করা হয়। কোভিড-১৯ এর প্রতিকার হিসেবে জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (এফ.ডি.এ.) ২০২০ সালের মে মাসে এই ওষুধটির অনুমোদন দেয়।