সামনেই পরীক্ষা, অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেবার ডেডলাইন, অফিসের কোন জরুরি কাজ… এত এত কাজ কখন শেষ করবো এটা ভেবেই আর শুরুই করা হয়ে উঠে না। তারপরে একেবারে অন্তিম মুহুর্তে এসে তড়িঘড়ি করে কোন রকমে কাজগুলো শেষ করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা। কখনো কখনো হয়তো মোটামুটি ভাবে কাজটা হয়ে গেলেও নানা রকমের ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হয়। সেই সাথে নিজের সাথে মিথ্যে শপথ নেয়া হয় যে, এর পরের বার ঠিক সময়ে কাজ শুরু করবো। এবং অতঃপর পরের বারও একি ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়।
প্রোক্রাস্টিনেশন শব্দটার সহজ বাংলা হলো ‘গড়িমসি করা’ বা ‘দীর্ঘসূত্রতা’। কোন গুরুত্ত্বপূর্ণ কাজ করার সময় সেই কাজের কোন কিছুই না করে অন্যান্য ছোটখাট নগণ্য কাজের মধ্য দিয়ে নিজের সময় নষ্ট করার প্রবৃত্তিকেই বলে গড়িমসি করা। “প্রোক্রাস্টিনাস” তাদের বলা হয় যারা বিশ্বাস করে যে কোন কাজ “পরে করবো’; এটা তারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে অথবা নিছক অভ্যাসের বশেই করে থাকে।
“আজ না, কাল করবো- জনৈক প্রোক্রাস্টিনেটর”; ছবি কৃতজ্ঞতাঃ bbc.com
এই বিশেষ বৈশিষ্ট্য মানুষকে উদ্যমী হতে দেয় না। যে স্বপ্নগুলো সে বিছানায় শুয়ে দেখছে তা বাস্তবায়নের জন্য সেখান থেকে উঠে তার যে কাজ করা উচিত, সেই জোরটুকুই সে নিজের মধ্যে আনতে পারে না। খুবই নেতিবাচকভাবে এরা আগামীতে বিশ্বাস করা মানুষ, সব কিছুরই জন্য অনেক সময় আছে এটা ধরে নিয়ে এরা সময়ের সবচেয়ে বড় অপচয় করে থাকে। এর পিছনে অনেক কারণই থাকতে পারে। যেমন, ইচ্ছাশক্তির অভাব, সিদ্ধান্তহীনতা, মোটিভেশনের অভাব, নির্দিষ্ট কোন লক্ষ্য না থাকা, শৃঙ্খলার অভাব ইত্যাদি।
কিন্তু, এই অলসতা বা গড়িমসি করার পিছনে কি কোন বিশেষ মানসিক কারণ থাকতে পারে? প্রোক্রাস্টিনেশন-কে কি কোন মানসিক ব্যাধি বলা যায়?
প্রোক্রাস্টিনেশনের কারণে মানুষ জরুরি কাজ ফেলে অদরকারি কাজ করতে থাকে;ছবি কৃতজ্ঞতাঃ qz.com
বেশির ভাগ মানুষের মধ্যেই কিছু পরিমাণ অলসতা দেখা যায়, কিন্তু এর পরিমাণ যদি অতিরিক্ত হয় এবং ব্যাপ্তি যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে অবশ্যই এটি গুরুতর সমস্যা। প্রোক্রাস্টিনেটররা ইচ্ছাকৃতভাবে কঠিন কাজ গুলো দেরিতে শুরু করে অথবা কোন সময় কাটানোর বিকল্প উপায় খুঁজে বের করে যেটা তাদেরকে প্রোক্রাস্টিনেশনে সাহায্য করে ; বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই ধরণের মানুষদের মধ্যে আত্ম-সংযমের অভাব দেখতে পাওয়া যায়। এদের কাছে ভবিষ্যতের কোন লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য পূরণের চাইতে ‘এখন কি মনে হচ্ছে’ বা ‘এখন এই কাজটা করতে ইচ্ছে করছে না’ এই আবেগটা বেশি প্রাধান্য পায়। এইভাবে তারা নিজেদেরকে একটা নিজেদের বানানো ধোঁকার ভিতরে রাখে, ক্ষেত্রবিশেষে তারা এই সত্য সম্পর্কে অবগতও থাকে।
পারফেক্টশনিস্টরা বেশির ভাগসময়েই প্রোক্রাস্টিনেটর হয়ে থাকে। কোন কাজ সম্পর্কে যদি কেউ অবাস্তব এবং খুব বেশি সঠিক কোন ফলাফল আশা করে থাকে, তখন ঐ কাঙ্ক্ষিত পরিণাম নাও আসতে পাবার ভয়েই সাধারণত মানুষ ঐ কাজটা নিয়ে গড়িমসি করে। এই কারণেই কোন কাজের ফলাফল সবসময় বাস্তবিকভাবে ভাবা উচিত।
প্রধানত ৩ ধরণের প্রোক্রাস্টিনেশন আছে ;
“অ্যারাউসাল টাইপ” (Arousal Type) : এরা কিছুটা থ্রিল-প্রেমী, শেষ মুহুর্তে কাজ করার ইউরোফিক আনন্দের জন্য অপেক্ষা করেন।
“অ্যাভয়ডার টাইপ” (Avoider Type) : এরা সফলতা-ব্যর্থতার ভয়ে কাজ নিয়ে দেরি করতে থাকেন। সাধারণত, এরা সোশাল গ্যাদারিং ইনসিকিউরিটিতেও ভোগেন এবং মানুষ তাদের নিয়ে কি ভাবছেন, তা নিয়ে অনেক বেশি চিন্তা করেন।
“ডিসিশনাল টাইপ” (Decisional Type) : এরা সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন, সিদ্ধান্ত না নিতে পারার কারণে এরা কোন কাজ শুরু করতে পারেন না।
যে ধরণেরই প্রোক্রাস্টিনেশন হোক না কেন, এর নানা রকমের স্বাস্থ্যগত নেতিবাচক দিক রয়েছে। এছাড়াও ডিপ্রেশন ও এংজাইটি এরসাথেও এর গভীর সম্পর্ক রয়েছে।
একজন মানুষের কার্যক্ষমতার উপরে নেগেটিভ ইফেক্ট ফেলা এই বদভ্যাসটির সরাসরি ডিপ্রেশন, লো সেলফ-ইস্টিম, নিজেকে দোষারোপ করার প্রবৃত্তি , ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স ইত্যাদির সাথে সম্পর্ক রয়েছে। পরিবেশ, সমাজ-সংস্কৃতি, পারিবারিক মুল্যবোধ এর সাথেও এর সম্পর্ক বিদ্যমান।
প্রোক্রাস্টিনেশনের কারণে মানুষ জরুরি কাজ নিয়ে গড়িমসি করে;ছবি কৃতজ্ঞতাঃ procrastination.com
১৯৯২ সালে করা ভারমন্ট ইউনিভার্সিটিতে করা একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, ৫২% শিক্ষার্থী প্রোক্রাস্টিনেশনের কারণে মানসিক সাহায্য আশা করছেন। শতকরা ৮০-৯৫ ভাগ শিক্ষার্থী বলেন যে, তারা প্রোক্রাস্টিনেট করেন এবং ২০% এর মত ক্রনিক প্রোক্রাস্টিনেশনে আক্রান্ত। প্রোক্রাস্টিনেশনের প্রধান সাইকোলজিকাল কারণের মধ্যে রয়েছে “প্লেজার প্রিন্সিপাল” ; কঠিন স্ট্রেসফুল কোন কাজ দেরিতে করে যে ক্ষণিকের আনন্দ লাভ করা যায় তা উপভোগ করার জন্যই গড়িমসি করা। এরপর যখন কাজের অন্তিম সময় কাছাকাছি চলে আসে, তখন মূলত ২ ধরণের কোপিং মেকানিজম কাজ করে।
প্রথম ধরণে যত সময় আগাতে থাকবে, তত স্ট্রেস বাড়তে থাকবে কাজ না করার কারণে এবং এই বাড়তি চাপ তাকে আরো প্রোক্রাস্টিনেশনের দিকে এগিয়ে দেয়। এই ধরণে, মূলত ইম্পালসিভ বিহেভিয়ারের কারণে সে এই এংজাইটি ফিল করে। এই কারণে ২য় ধরণের মত সে সমস্যা সমাধানের দিকে মনযোগ না দিয়ে বরং নেগেটিভ কোপিং বিহেভিয়ার প্রদর্শন করে।
এই নেগেটিভ কোপিং বিহেভিয়ারগুলো ৭ রকমের :
- অ্যাভয়ডেন্স (Avoidance) : যে জায়গায় কাজটি সম্পন্ন হবে, সেই জায়গা এড়িয়ে চলা। যেমন, কোন অ্যাসাইনমেন্ট জমা না দেয়ার হলে ক্লাসরুমে না যাওয়া।
- ডিনায়েল ও ট্রিভিয়ালাইজেশন (Denial & Trivialization) : এটা ভেবে নেয়া যে প্রোক্রাস্টিনেশন করা হচ্ছে না, বরং গুরুত্বপূর্ণ কাজটার চাইতেও অনেক জরুরি কাজ আছে, বাস্তবে যা সত্য নয়।
- ডিস্ট্র্যাকশন (Distraction) : সাবজেক্ট যখন কোন কাজ এড়াতে গিয়ে অন্য কাজে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। এই ধরণের মানুষের আত্ম-সংযম থাকে না; সাধারণত ( ঘন্টার পর ঘন্টা সিরিয়াল দেখা, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে ব্রাউজ করা ইত্যাদি)।
- ডিসেন্ডিং কাউন্টার ফ্যাক্টুয়ালিটি (Descending Counter-factuality) : নিজের প্রোক্রাস্টিনেশন কে অন্যের সাথে তুলনা করে যাচাই করা ( নিজে পরীক্ষার ২ দিন আগে পড়ে B- পেলাম, আর ও তো ৭ দিন ধরে পড়েও ফেল করলো )।
- ভ্যালোরাইজেশন (Valorisation) : যে কাজটা গুরুত্ব দিয়ে করা উচিত, সেটা না করে অন্য একটা কাজ করে সেটা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা।
- ব্লেমিং (Blaming) : অন্যান্য বাহ্যিক কারণের উপর মিথ্যে দোষারোপ করা ( অ্যাসাইনমেন্ট টাই তো কঠিন, এইজন্য করি নাই )।
- মকিং (Mocking) : হিউমার সেন্সের মাধ্যমে অন্যকে হেয় করে নিজের প্রোক্রাস্টিনেশন টাকে বৈধতা দেয়া ( এত্ত পড়ে কি হবে?, জীবনে কি কাজটাই সব? )।
প্রোক্রাস্টিনেশন নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, এটি মস্তিষ্কের “প্রিফ্রন্টাল করটেক্স” (Prefrontal Cortex) এর সাথে সম্পৃক্ত ; যা ব্রেনের সেই অংশ যেখানে ইম্পালস কন্ট্রোল, মনোযোগ ধরে রাখা এবং প্ল্যানিং এইসব কাজগুলো হয়ে থাকে। এর কারণে হতাশা সহ নানা রকম মানসিক সমস্যার পাশাপাশি ইনসমনিয়া বা অনিদ্রা, গ্যাস্ট্রো-ভাস্কুলার সমস্যা ইত্যাদি হতে পারে।
প্রোক্রাস্টিনেশন সাইকেল; ছবি কৃতজ্ঞতাঃ thecreativelife.net
সুখের বিষয় এই যে, প্রোক্রাস্টিনেশন নিরাময়যোগ্য। যারা ক্রনিক প্রোক্রাস্টিনেশনে আক্রান্ত, তাদের জন্য রয়েছে থেরাপি। এছাড়াও যারা থেরাপি এফোর্ড করতে পারেন না, তাদের জন্য রয়েছে “বিহেভিয়ারিয়েল অ্যাক্টিভেশন” এর মত নিজে নিজে করা যাবে এমন সমাধান। নিচে দেয়া হলো প্রোক্রাস্টিনেশন দূর করার কিছু টিপস :
- নিজের অভ্যাস এবং চিন্তা সম্পর্কে সচেতন থাকা
- নিজের আত্মবিশ্বাসের অভাব, ঠিকমত টাইম ম্যানেজমেন্ট করতে না পারা, দক্ষতা বাড়ানো, ভয় হতাশা দূর করা ইত্যাদির জন্য সাহায্য নেয়া। সেটা প্রফেশনাল হোক, অথবা গুগল থেকেই হোক।
- নিজেকে সঠিকভাবে জানা অর্থাৎ, নিজের উদ্দেশ্য, লক্ষ্য, ক্ষমতা, সামর্থ্য, দুর্বলতা ইত্যাদি সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা থাকা।
- পারফেক্টনিজমে বিশ্বাসী না হয়ে বাস্তব লক্ষ্য ঠিক করা।
- ডেইলি রুটিন তৈরি করা এবং সেটা কঠিনভাবে মেনে চলা। এ ক্ষেত্রে সহজ রুটিন বানানোই উত্তম।
- অনেক সময়েই আশেপাশের পরিবেশ এবং সঙ্গের কারণে মানুষ প্রোক্রাস্টিনেট করে। এই কারণে পরিবেশ এবং আশেপাশের মানুষগুলো যেন প্রোডাক্টিভ থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
- নিজেকে এমনভাবে প্রস্তুত করতে হবে, যেন অনেকগুলো কাজের মধ্য থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজটা বের করে আনতে পারা যায়।
- সামাজিক মেলামেশা বাড়াতে হবে; মন ভালো থাকে এমন কাজগুলোও যেন দৈনিক রুটিনে থাকে।
- যে কোন বড় কাজ ভাগ করে অল্প অল্প সময় নিয়ে মাঝে বিরতি দিয়ে করার অভ্যাস করা। এতে কর্মদক্ষতা বাড়ে।
- প্রতিটি কাজ শেষ করার পরে নিজের জন্য একটি ছোট্ট পুরষ্কারের ব্যবস্থা করা যাতে পরবর্তীতে কাজের প্রতি আগ্রহটা থাকে।
- নিজেকে নিজের বাহবা দেয়া যেমন শিখতে হবে কাজ শেষ করার পর, ঠিক তেমনি কাজ না করলে কোন পছন্দের কাজ স্যাক্রিফাইস করে নিজেকে শাস্তি দেয়াও শিখতে হবে।
গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে না রেখে প্রায়োরিটি বেসিসে কাজ করা উচিত; ছবি কৃতজ্ঞতাঃ cohive.space
যদি কেউ এইসব মেনে চলার পরেও কোন ধরণের সমস্যায় ভুগে থাকে, কাজের কোন রকমের আগ্রহ না পায় তাহলে অবশ্যই প্রফেশনাল হেল্প নেয়া উচিত। সর্বোপরি, প্রোক্রাস্টিনেশন সবার স্বপ্ন পূরণের পথের সবচেয়ে বড় বাধা- এই চিন্তাটা মাথায় এনে নিজেকে এবং নিজের ইচ্ছাশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা শিখতে পারলেই এর ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করা যাবে নিজেদের, সচেতন করা যাবে আশেপাশের মানুষদেরও।
ফিচার ছবিঃ oxfordlearning.com
তথ্যসূত্রঃ
১. https://thecreativelife.net/stop-procrastinating/
২. https://www.bbc.com/news/health-45295392
৩. https://procrastination.com/what-is-procrastination
৪. https://www.psychologytoday.com/us/basics/procrastination
৫. https://cohive.space/blogs/the-science-behind-procrastination-how-to-fix-it/